সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন

আজ ঐতিহাসিক ‘শিমুলিয়া’র গণহত্যা’ দিবস

রুহুল আমিন কিশোরী / ৬৪৫ Time View
Update : শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০

আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালের১১ডিসেম্বর,সোমবার বিকাল ৫ টায় কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার শিমুলিয়ায় সংঘটিত হয় সৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলের সবচেয়ে বৃহত্তম, ভয়াবহ, নৃশংস হত্যাকান্ড,লুঠপাট,অগ্নি সংযোগ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা। তখনকার সময়ের কিশোর, যুবক যারা আজ প্রৌঢ়, প্রবীন তারা এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। তখন মোবাইল, ফেসবুক কিংবা বিশ্বায়ন বাংলাদেশ বুঝে ও নাই কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ঘটনা শিমুলিয়া গ্রামকে বিশ্ব গ্রামে পরিণত করেছ।প্রবাসী বাংলাদেশী সহ সারা বিশ্বের মানুষ তখন শিমুলিয়া শিরোনাম শুনতে উন্মুখ।

কী ঘটেছিলো সেদিন শিমুলিয়ায়?

শিমুলিয়ার কৃতী সন্তান ‘শিমুলিয়ার পীর’ নামে খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর(অবঃ) মতিউর রহমান (সহকারি সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন ক্যাপ্টেন) ওরফে মতি মেজর সাহেবের কাছে হিন্দু যুবকের ধর্মান্তরিত হওয়ার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ চারদিক থেকে শিমুলিয়া গ্রামকে ঘিরে ফেলে। একটু পরেই শুরু করে নির্বিচারে চারপাশ থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ।নিরীহ গ্রামবাসী আবাল বৃদ্ধ বনিতা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে তাদের কাঁচা মাটির ঘরে প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরে। চেষ্টা করে প্রিয় প্রাণ নিয়ে পালানোর কিন্তু পথতো বন্ধ। তারা যাবে কোথায়,কিভাবে ? নিরাশ হয়ে ফিরে এসে আল্লাহর উপর ভরসা করে কোনোমতে রাত কাটায়।শেষ রাতে কিছুটা বিরতি দিয়ে মঙ্গলবার এবং বুধবার সারাদিন চলে থেমে থেমে গুলিবর্ষণ। সেই সাথে পুরো গ্রামের ঘরে ঘরে অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা যেনো মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চ নাটকের মঞ্চায়ন। মদদ দেয় মেজরের সাথে
মতানৈক্য কারী কিছু আলেম ও রাজাকার। তারা দেখতে ও শুনতে চায় পীর মেজরের মুরিদানদের হাহাকার!!! তারা একটিবারের জন্যও ভাবেনি যে,’নগর পুরিলে দেবালয় ও এড়ায়না’ অথবা এই গ্রামে রয়েছে অনেক অবলা নারী অসহায় শিশু,বয়োবৃদ্ধ। ইসলামিক আইনে ও “এই তিন শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেই সাথে গাছ ও ক্ষেতের ফসল নষ্ট করতে নিষেধ করেছেন,” প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।

ইসলাম কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বী কৃতি দানকারীর দাবিদার সৈরাচার এরশাদ সরকার অতীতের সকল বর্বরতার রেকর্ড ভেঙে ফেলে। তিনদিন স্থায়ী এই অহেতুক, অনর্থক ও অসম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় পুলিশের ক্রসফায়ারে ২ জন পুলিশ সদস্য ও পীরজাদাসহ মোট ২২ টি তাজা প্রাণ জড়ে পড়ে, পঙ্গুত্ব বরণ করেন
এবং নিখোঁজ হন অনেকে। নিখোঁজদের তালিকায় আমার চাচা মোহাম্মদ লিয়াকত আলী ও রয়েছেন।আমার মামী তাঁর ২১ দিনের বাচ্চার থেকে আলাদা হয়ে পড়েন গোলাগুলির কারণে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুলেরঘাটের বাসায় ফিরে আসেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন আমার নানা ( মামার শ্বশুর) ও ওনার পরিবার।আমার ছোট নানা ও মায়ের সহপাঠী তরুণ সাংবাদিক এম সাইদুল ইসলাম। ওনি তখন দৈনিক ইনকিলাব, সংগ্রাম ও দিনকাল পত্রিকার পাকুন্দিয়া উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে প্রকৃত সত্য ঘটনা বস্তুনিষ্ঠ ভাবে দেশ ও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন অকুতোভয় কলম সৈনিক হিসেবে। কিন্তু পুলিশের রোষানলে পড়তে হয় ওনাকে। মাথায় গুলি বিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেওয়ার পথে বৃহস্পতিবার রাতে কাপাসিয়ার টোক বাজার এলাকায় গ্রেফতার হন পীর মেজর মতিউর রহমান। এর ঠিক দুই মাস পর ১৯৯০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পাকুন্দিয়া থানার তৎকালীন ওসি শাহাব উদ্দিন কোনো কারণ ছাড়াই সাংবাদিক এম সাইদুল ইসলাম কে ওনার পুলেরঘাটের বুকস্টল থেকে গ্রেফতার করেন এবং থানায় নিয়ে ওনার উপর চালানো হয় অকথ্য, অমানুষিক, বর্বর নির্যাতন। বুটের তলায় ভেঙে পিষে দেওয়া হয় ওনার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল যাতে আর কোনোদিন হাতে কলম ধরতে না পারেন।মেজর মতিউর রহমান সহ একাধিক ব্যক্তি ও ওনার নামে রাষ্টদ্রোহ সহ মোট ৭টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। অন্যায়ভাবে জেলে আটকে রাখা হয়। চিনিরকলের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় । তখন ওনার অনুপস্থিতিতে দোকানটা ও বেদখল হয়ে যায়। ওনার স্ত্রী, পুত্র,কন্যাগণ কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করেন।সন্তানদের পড়ালেখাও বন্ধের উপক্রম হয়।ওনার বড়ো ভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আদর্শ লাইব্রেরি ‘র স্বত্বাধিকারী জনাব শামছুল ইসলাম সাহেবকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মানসিকভাবে চাপে রাখা হয়।ছয়মাস পর ওনি জামিনে মুক্তি পান।এর ঠিক দুই মাস পর ১০ ডিসেম্বর, ১৯৯০ প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে সৈরাচার হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের পতন হয়।তাঁর সেনা প্রধান ও তাঁকে রক্ষা য় এগিয়ে আসেননি। নয় বছরের পরাক্রমশালী শাসক রাষ্ট্রপ্রধান ও সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদকে ও যেতে হয় জেলে থাকেন টানা ছয় বছর। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার আমলে সকল মামলা থেকে আসামিগণ বেকসুর খালাস লাভ করেন। কিন্ত কে ফিরিয়ে দিবে শিমুলিয়াবাসীর সুবর্ণ সময়, সুখের দিন,সোনার সংসার?

এই দিনের ঘটনা স্মরণ করে আজো অনেকে আঁতকে উঠেন, সম্পদ, সম্ভ্রম,
স্বজন হারানোর ব্যথা, বেদনায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। স্বাধীন দেশে এমন তো হওয়ার কথা ছিলোনা।কেন হলো, কারা দায়ী? তারা যারাই হোক,যত শক্তিশালীই হোক না কেন তারা আসামি হিসেবে রবে ইতিহাসের কাঠগড়ায়, ‘কীরমান কাতীবিন’র খাতায়।আর ইতিহাস ও সময় কখনো কাউকে ক্ষমা করেনা। সময়ের পরিবর্তনে শাসক পরিবর্তন হয়;দলন,দমন,পীড়ন, শাসন,
শোষন,নিপীড়ন,নিষ্পেষণ ও বঞ্চনার কখনো অবসান হয়না।সাথে সৈরশাসন ব্যবস্থার ও।এইদিনে তৎকালীন স্থানীয় সরকারের সদস্যগণ, প্রশাসন ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা ও অদূর দর্শিতার কারণে যাঁরা নির্মম ভাবে নিহত ও নিখোঁজ হয়েছিলেন তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি আর যাঁরা বেঁচে আছেন তাদের নিরাপদ,সুখী, সুন্দর, সুস্থ দীর্ঘজীবন কামনা করছি। আল্লাহ হাফেজ। “জয় হোক মানবতার।” “অবসান হোক লাঞ্চনা আর বঞ্চনার।

আমিন সাদিক ( রুহুল আমিন কিশোরী)
কবি, কথাসাহিত্যিক, সমালোচক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category