শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ : ভাবনা-দুর্ভাবনা
Update : বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৫:২৭ অপরাহ্ণ

সুলতান আফজাল আইয়ূবী

ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির প্রধান বাহন। ভাষা মানুষকে দেশ হতে দেশান্তরে, কাল থেকে কালন্তরে নিয়ে যায়। ভাষা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, আন্দোলিত করে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মায়ের প্রতি যেমন থাকে সন্তানের ভালবাসা ও শ্রদ্ধাভক্তি ; তেমনি মাতৃভাষার প্রতিও রয়েছে আমাদের অকৃত্তিম ভালবাসা। কেননা, এই ভাষার মাধ্যমেই মানুষ তার হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে থাকা সুখ,দুঃখ,চিন্তা-চেতনা ও মনের অনুভূতি প্রকাশ করে থাকে। বাংলা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। ইতিহাসে একটি মাত্র ভাষা বাংলা, যার জন্য মানুষের রক্ত ঝরেছে এবং মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভাষাভাষীদের সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলা পৃথিবীতে চতুর্থ, মতান্তরে পঞ্চম স্থান অধিকার করে আছে। ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, সাহিত্য, সব মানদণ্ডেই বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী থেকে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারে বাংলা ভাষার স্থান ৪র্থ ও বিশ্বে ৬ষ্ঠ এবং বিশ্বব্যাপী মোট ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যানুসারে বাংলা ভাষা পৃথিবীর ৭ম বৃহত্তম ভাষা। বিশ্বের ২৬০ মিলিয়ন বা ২৬ কোটিরও বেশী মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষার বর্ণাঢ্য ইতিহাস নিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের গর্ব করা উচিত। তবে আমরা যদিও গর্ব করে থাকি। কিন্তু ভাষার সঠিক মূল্যায়ন আমরা আজও করতে পারছি না। এ কথাটি চিরন্তন সত্য। বাংলা ভাষা একটি সহজ, সরল এবং শ্রুতিমধুর ভাষা থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত আমরা একে জটিল ও শ্রুতিকটু করে ফেলছি। আমরা নানাভাবে এ ভাষার বিকৃতি করে চলছি। শুধু তাই নয়, অনেকক্ষেত্রে আমরা এ ভাষাকে অবহেলা করে বাংলা ভাষা হতে দূরত্ব বজায় রেখে বিদেশী ভাষার চর্চায় মেতে উঠছি। এই  কাজটা হয়তো আমরা অসচেতনভাবে বা সচেতনভাবেই করছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা একেবারেই উদাসীন। শুধু ভাষার মাস আসলেই আমরা বাংলা ভাষার চেতনা ফেরি করি। আবার ভাষার মাস আসলেই কিছু নামধারী ভাষা চেতনা নিয়ে ধাপ্পাবাজ ফেরিওয়ালাদেরও দেখা যায়। এরাই আবার সারা বছর বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে চলছে। আমাদের এ ব্যাপারে এখনই সচেতন  হওয়া উচিত। সমকালীন আধুনিক সংস্কৃতি ও মিডিয়ার প্রভাবে আজ বাংলা ভাষার সাথে হিন্দি, ইংরেজি আরও নানা ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে। যেটা কোনো বিবেকবান,সচেতন, সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারেনা নয়। কালের আবর্তে ও সমকালীন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রভাবে পৃথিবী থেকে ইতোমধ্যে কিছু কিছু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে আরও কিছু ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। আমাদের সচেতন না হলে, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বাংলা ভাষা বিলুপ্ত যে হবেনা এর নিশ্চয়তা কি? বিলুপ্ত না হলেও অন্তত বাংলা ভাষা যে বিকৃত হয়েছ আরও হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে নানাদেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণে  বাংলা ভাষার বিকৃতি কিংবা বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার মিশ্রণ এখন আর অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। বর্তমানে দেশের নামকরা এফএম রেডিও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপকরা শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলাকে ইংরেজির মতো করে বাংলিশ কায়দায় উপস্থাপনা ও কথাবার্তা বলেন। উপস্থাপকরা যখন এভাবে বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন এবং অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত শিল্পী অতিথিরাও যখন এ ধরনের মিশ্রিত বাংলিশ ভাষায় কথা বলেন, তখন রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলা ভাষার বিকৃতি হচ্ছে এমনটাই সচেতন বাঙ্গালিদের কাছে মনে হয়। এতে করে আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করতে তাদের অনুসরণ ও অনুকরণ করছে। সেজন্যই সমকালীন তরুণ-তরুণীদেরকে দেখা যায় কথায় কথায় হিন্দি ও ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার করছে। কোন এক ম্যাগাজিনের ভাষা দিবস সংখ্যায় এক লেখক ভাষা বিকৃতি সম্পর্কে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন ” ব্রিটিশ ২০০ বছরে যা করে নাই, পাকিস্তানিরা ২৪ বছরে যা করতে পারে নাই, এফএম রেডিও গত ৬ বছরে সেটা করে দেখাল। যে হারে ওরা আমাদের বাংলার উচ্চারনের ১২টা বাজাইতেছে আর ইংরেজির মিশ্রণ করছে। ৫২ সালে জিন্নাহ যদি এই কৌশল জানতে পারত তাহলে এতগুলো মানুষ না মেরে কয়েকটা এফএম রেডিও চালু করে দিত”। কথাটি লেখক আক্ষেপের সুরেই ব্যাঙ্গ করেছেন। আধুনিক সংস্কৃতির করাল গ্রাসে বাঙ্গালির অস্তিত্ব বাংলা ভাষা কি তার নিজস্ব অস্তিত্ব হারাচ্ছে? ভাষা পরিবর্তনশীল। বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই পরিবর্তন বা আধুনিকতার নামে ভাষার মৌলিকতা বিকৃতি কখনোই কাম্য নয়। ভাষার রুপ, মাধুর্য, সৌন্দর্য রক্ষা করা জরুরি। বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হওয়া দরকার। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়তই ইংরেজি শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে চলছে। সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার থেকে দিন দিন বহু শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম ‘মা’ কে বলে ‘মাম্মি’, অথচ মা ডাকটি কত শ্রুতি মধুর! বাবাকে বলে ‘ড্যাডি’, ভাইকে বলে, ‘ব্রো’। এরকম অসংখ্য উদাহারণ দেওয়া যাবে। আমাদের বাংলা ভাষাকে ব্যবহার না করার প্রবণতাও কোন অংশেই কম নয়। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,দোকান, সংগঠন ইত্যাদির নামকরণ করা হয় ইংরেজিতে। কিন্তু আমরা চাইলেই বাংলা শব্দ ভান্ডার থেকে সুন্দর কিছু বাংলা নামে এসব প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতে পারি। আমরা যে মাটিতে জন্মেছি সে মাটি, মানুষ,  মানুষের ভাষার শব্দমালা ও ভাষার প্রতি ভালবাসাই হল প্রকৃত দেশ প্রেম। আমার মায়ের মুখনিসৃত শব্দমালা, ভাষার প্রতি অনিহা ও ভাষার বিকৃতি করা প্রমাণ করে বাঙ্গালি জাতি দিন দিন কতটা দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন, মূল্যবোধহীন হয়ে বেড়ে উঠছে। মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষাই হল প্রকৃত একুশের চেতনা। বাংলা ভাষা হলো বাঙালি জাতির পরিচয়চিহ্ন। মনে রাখতে হবে ভাষার বিলুপ্তি মানে সভ্যতার একটি প্রধান অংশ বিলুপ্ত হওয়া। তাই বাংলা ভাষাকে বিকৃত করা কিংবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার না করার প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ ভাষা আমাদের। তাই এই ভাষাকে সংরক্ষণ করার দায়িত্বও আমাদের। ভাষার মাসে হোক এটি আমাদের দৃঢ় শপথ। অমর একুশ বাঙালির ইতিহাসে শুধু একটি তারিখ নয়; একুশ হলো এক অবিনাশী চেতনার বীজমন্ত্র।  ভাষার প্রতি ভালবাসা শুধু ভাষার মাসে নয়, শুধু একদিন নয়। ভাষার প্রতি ভালবাসা হোক বছরের প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত।

সম্পাদক, লিটল ম্যাগাজিন ‘নবসুর ‘
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, পাকুন্দিয়া প্রতিদিন

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
আমাদের ফেইসবুক পেইজ