বুবাই….
বুবাই, মানে আমার দাদী মৃত্যুবরন করেছেন ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে,আমি তখন পাকুন্দিয়ার চরকাওনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ি। ১৯৮৬ সালে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা সম্ভবত ১৯ ডিসেম্বর’৮৬, আমার বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার কথা এবং প্রস্তুতিও নিয়েছি। আমাদের বাড়ি চরটেকী হলেও, মরহুম আবদুল হাই স্যার ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম মৌলবী মোঃ খুর্শীদ উদ্দিন স্যারের অনুপ্রেরণায় চরকাওনা বহুমুখী হাইস্কুল সংলগ্ন “চরকাওনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়” এ আমরা অনেক ভাই বোন এমন কি চাচাতো ভাই বোনেরাও এই স্কুলে পড়ালেখা করেছি। আমি দাদীর ঘরে থাকি,আমাদের দাদী খুবই আদর করতেন সবাইকে।দাদীকে আমি “বুবাই” বলে ডাকতাম যেমনটা আমি মা’কে “মায়া” বলে ডাকি,অন্য ভাই বোনেরা আম্মা ডাকলেও আমি “মায়া” শব্দটি ভালো লাগে,আমি আমার মেয়ে সুহাসিনী কে এখন মায়া বলে ডাকি,আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত “মায়া” কে হারাতে চাই না, তাই এই মায়া ডাকা। মা আজ অনেক অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি।
বলছিলাম দাদীর কথা,আমার দাদীর বোনের সংখ্যা ১৮ জন, তাঁর বাবা ছিলেন তৎকালীন সময়ে চর এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি,জুরি বোর্ডের হাকিম মরহুম কন্দার বাপ। আমার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার আগের রাত, দাদী অসুস্থ কিছুটা,আমি দাদীর ঘরে থাকি,রাতে পড়ালেখা শেষ করে ঘুমিয়ে আছি, মধ্যরাতে দাদী আমাকে ডেকে পশ্রাব করার জন্য ঘরের বাহিরে নিয়ে যায়,উঠানে পশ্রাব করা শেষ এবার দাদী বলেন তাড়াতাড়ি হবড়ি (পেয়ারা) গাছে উঠ্,হবড়ি পার্,খা-খায় তাড়াতাড়ি খায়,এই লুকোচুরি কারন এই গাছটি ছিলো আমাদের বাপ-চাচাদের,প্রচুর পেয়ারা হতো আর এইগুলা খাওয়া নিয়া প্রায়ই মন কষাকষি হতো মা-চাচীদের মধ্য। সেইরাতে আমার দুই ফুফু দাদীর সাথে ছিলো,স্পষ্ট মনে আছে সেই রাতে বিভিন্ন পিঠা বানিয়েছিলেন ফুফুরা,এর মধ্যে মসলা পিঠা আমার প্রিয়, পিঠা খেয়ে যতারিতি ঘুমিয়ে ছিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার মুখে উপরে পিঠা,বুঝতে বাকি নাই ঘুমের মধ্যে আমাকে পিঠা খাওয়াইছেন দাদী।যাক্ আজ আমার বৃত্তি পরীক্ষা, গোসল করতেছিলাম কুয়ার পানিতে,আমার ‘মা’ গোসল করাচ্ছেন আমাকে,হ ঠাৎ শুনি চিৎকার চেচামেচি, কেহ যেন বললো আমার দাদী মারা গেছে! দৌড়ে গিয়ে দাদীকে দেখি তিনি আর নেই,এখনো স্পষ্ট মনে আছে সাদা আর নীল রংয়ের পাড়ের কাপড় দিয়ে গোছানো অবস্থা শুয়ে আছেন আমার বুবাই। সবার তাগিদে আমি পরীক্ষায় অংশ নিতে পাকুন্দিয়া চলে যাই,মরহুম দাদীর জানাজা আমার দেখা বা পড়া হয়নি।
আগেই বলেছি দাদীর বোনেরা ১৮ জন ছিলেন,তাদের মধ্যে ৫ জনের বিয়ে হয়েছিলো চরটেকী গ্রামেই,প্রায় সবার বাড়িতেই কম বেশি যাওয়া হতো, তবে বেশি যাওয়া আসা হতো শামীম আহম্মদ চেয়ারম্যান ভাইয়ের দাদীর কাছে,মূলতঃ সরকার কবির আহমেদ বাল্যবন্ধু হওয়া সকাল বিকালে যেতাম,অনেক স্মৃতিই মনে হয়,কত না সহজ সরল ছিলো দাদীরা।
শুধু দাদীর কথা বলছি এইজন্য যে দাদাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে দাদা’র উপর অনেক সময় ক্ষিপ্ত হই,তিনি আমাদের বাড়ির সামনে আরেকজন কে জঙ্গলের পিছন থেকে এনে বাড়ির করার অনুমতি দিয়ে আজ আমাদের ঘরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
একদিনের কথা মনে পরে, বিকাল বেলা কবির কে খুঁজে না পেয়ে তাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ দাদী (দাদীর বোন) উত্তরের ঘড় থেকে হাতের ইশারায় ডাকে,আমি জানি কিছু একটা খাবার খাওয়ানোর জন্য এই ডাক,আমিতো সাড়া দেইনা,তখন বার বার বলতেছে এই ছেঁড়া আমার কাছে থেকে টাকা নেয় তারাকান্দি বাজার হতে আমার জন্য গুড় আনতে হবে,গেলাম দরজার কাছাকাছি আর খপ করে হাতে কব্জায় ধরে নিয়ে দরজার আড়ালে নিয়ে গুড় আমার মুখে দিয়ে বলে খা-খায় তাড়াতাড়ি খায়।
দাদীর বোনেরা সবাই একই রকম ছিলেন,চরটেকীতে অন্য দাদী মানে নবী কাকার মা,মরহুম বীরমুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস কাঞ্চন কাকা মা ও আমির উদ্দিন কাকার মা,উনারাও একইভাবে আদর করতেন। আজ আর কেহ নেই,সবার জন্য দোয়া করি আল্লাহ তাদের কে বেহেশত নসীব করুন।
মোঃ শফিকুল ইসলাম শফিক
এজিএম(প্লানিং)
আনোয়ার গ্রুপ,ঢাকা।