Pakundia Pratidin
ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৫ মে ২০২৩
  1. আন্তর্জাতিক
  2. ইতিহাস
  3. ইসলাম ও জীবন
  4. কৃতি সন্তান
  5. জাতীয়
  6. জেলার সংবাদ
  7. তাজা খবর
  8. পাকুন্দিয়ার সংবাদ
  9. ফিচার
  10. রাজনীতি
  11. সাহিত্য ও সংস্কৃতি
আজকের সর্বশেষ সবখবর

দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল

প্রতিবেদক
পাকুন্দিয়া প্রতিদিন ডেস্ক
মে ২৫, ২০২৩ ১২:১৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

গোলাপ আমিন

বাংলাসাহিত্য আকাশে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতু সম স্বর্ণপ্রভা উজ্জ্বল অনিবার্য বিস্ময়কর এক নাম।

তিনি ছিলেন দুঃখের অগ্নিলাভার ছাইভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখি হয়ে জন্ম নেওয়া বিরলপ্রজ ডানামেলা ক্ষিপ্ত ঈগল।

অবহেলিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে ছুঁ মেরে লাঘব করার অন্তর্হিত অনুপম তাগিদে যেন সারাটা জনম সাহিত্য সাধনার বহুমুখী কাণ্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন তিনি।

তিনি মনুষ্যমোহিত ও সাম্যবাদময় সমাজ বিনির্মাণে শ্বেত-শুভ্র পতাকা পতপত উড়াতে চেয়েছেন, গড়ে তুলতে চেয়েছেন প্রেম ও শান্তির এক মহাপৃথিবী।
কবি নজরুলের কলমই যেন এক মহার্ঘ্য অস্ত্র-তলোয়ার।
বাউণ্ডুলে উন্মাদনায় নবযুগ সৃষ্টির প্রয়াসে ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে তিনি ছুটে চলেছেন দিগ্বিদিক।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ভুবন ছিল একাধারে সুসমন্বিত দ্রোহ ও প্রেমের ভারসাম্যে ভরপুর।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি তাঁর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ রেখে স্বগৌরবে উচ্চারণ করেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’।
কবি নজরুলের দ্রোহ ও প্রেমকে স্বমহিমায় চিহ্নিত করতে এটিই কী যথেষ্ট নয়?
কী অসাধারণ বৈপরীত্যের অপূর্ব ও অনবদ্য মিল-মিশ্রণের সফল প্রযোজনা। একই সাথে ভিন্ন দুটি ধারাকে একটি মাত্র হৃদয়ের ভেতর ধারণ করতে পারাটা মোটেই খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। বরং এমনটি-ই বা কতজন করতে পারে। এমনটি করতে পারার অন্যতম একজন সফল নায়কের নাম কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই তো তিনি বিদ্রোহী কবি, প্রেম ও সাম্যবাদের কবি।
কল্যাণকামী স্বর্গ রচনার স্বপ্নে বিভোর প্রতিভূ প্রতিভাধর কবির কলম থেকে নির্ঝরের মতো অবিরাম ঝরেছে তাঁরই অমিয় বাণী।

ধ্যানে জ্ঞানে কবিতা-গানে প্রাণে তিনি ছিলেন চির-বিদ্রোহী।
দ্রোহের কঠিন-কঠোর পাষাণভরা বক্ষ নিয়েও তাঁর ভেতর ছিল বিস্তীর্ণ বাগানে ফুটে থাকা একগুচ্ছ ফুলের কোমল-পেলব পাপড়ির মতো প্রেমের সুঘ্রাণ। তিনি যেন পাথরে ফুল ফোটাতে চাওয়া এক ধ্যানী-জ্ঞানী মুনী-ঋষী।

কবি নজরুল আদর্শ রূপে অন্তরে যা বিশ্বাস করেছেন, তা তাঁর সাহিত্যে সকল শাখায় যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন এবং তিনি তাঁর বাস্তব জীবনেও সেটার ফলপ্রসূ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

তিনি সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ভারতবর্ষের প্রখ্যাত বামনেতা, রাজনীতিবিদ কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদের ছত্রছায়ায় ও সান্নিধ্যে থেকেছেন। তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রণোদনায় মাত্র ২১ বছর বয়সে কবি কাজী নজরুল ইসলাম দৈনিক নবযুগ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের একজন হিসেবে পত্রিকা প্রকাশের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। সান্ধ্য পত্রিকা হিসেবে ১২ জুলাই ১৯২০ সালে এটি প্রকাশ পেতে শুরু করে।

‘সাম্যবাদী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,’

এসবের প্রভাব তাঁর কবিতায় জীবন্ত হয়ে আছে।

মানুষকে মহান ও বড় করে দেখেছেন, আর ‘মানুষ’ কবিতায় লিখেছেন-
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

নারীজাতিকে মর্যাদার চোখে দেখে ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন-
‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’

‘হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক’ কবিতায় লিখেছেন-
হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুই আঁখি তারা
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।’

‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় লিখেছেন-
হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই
মাভৈঃ! মাভৈঃ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ
সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান গোরস্থান!’

তিনি তাঁর লেখায় প্রকাশ করেছেন-
‘মোরা একই বৃন্তে দুটী কুসুম হিন্দু-মোসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।’
এ আপ্তবাক্যটিতে তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন বলেই হয়তো তিনি হিন্দু রমণী আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা দেবীকে বিবাহ করেছিলেন।
সেইসাথে ছেলেদের নাম রেখেছিলেন ব্যতিক্রমী দৃষ্টিকোণ থেকে, যেমন- কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ, কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ।
কাজী নজরুল ইসলামের কোনো কন্যা সন্তান ছিল না, থাকলে হয়তো তিনি তাঁর মতো করেই নামটি রাখতেন। এসব কর্মকাণ্ড তো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, প্রেম-প্রীতি ও মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসার সর্বোচ্চ সমীকরণের অভিনব বহিঃপ্রকাশ। এসব বিষয়কে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কতটুকু দিল-দরিয়া মহৎ হৃদয়ের অধিকারী হলে এমনটি করা যায়, তা আশ্চর্য হয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাববার অবকাশ আছে।

জাতপাতকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে অথবা ভিন্ন ভিন্ন জাতি-ধর্মকে ‘মানুষ’ হিসেবে এক করে দেখার কারণে কী প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তা আমরা নিশ্চয়ই একটু দেখে নিতে পারি। মুসলমানরা বলেছে-
‘দেব দেবীর নাম মুখে আনে সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।’
আর অন্যদিকে ‘হিন্দুরা ভাবে, ফার্সি শব্দে কবিতা লেখে ও পাত নেড়ে।’

‘দেব দেবীর নাম মুখে আনে’ ও ‘ফারসী ভাষায় কবিতা লেখে’ -দুটি ধর্মের লোকেরা পারস্পরিক এসব অভিযোগের কথা বলে বলে কটাক্ষ করেছে, হেয় প্রতিপন্ন করেছে। তিনি কখনও দমবার পাত্র ছিলেন না।

বাংলাসাহিত্যে এটি কেবল কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বারা সম্ভবপর হয়েছে এবং তিনি তাঁর যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি তো এক বিরলপ্রজ ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ভিন্ন ধাতুতে গড়া অভিন্ন ব্যক্তিত্ব।

মানব মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে তিনি বিদ্রোহ করেছেন, মানব প্রেমের ভালোবাসায় নিমজ্জমান ছিলেন বিধায় তিনি প্রেমিক-মজনু হয়ে প্রেমের শরাব পান করেছেন।

বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণে তিনি জেল খেটেছেন আর অপরদিকে ব্যক্তিগত জীবনে ভালোবাসা ও নিখাদ প্রেমের খেসারত দিতে গিয়ে বহু অপমান-লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন।

দ্রোহী-চেতনা নিয়ে বাংলাসাহিত্যে চূড়াস্পর্শী উচ্চতায় তাঁর মতো আর কেউ পৌঁছাতে পারেননি।

কবি নজরুল দ্রোহী-চেতনার ভেতর প্রেমের বাতিঘর হয়ে আছেন অথবা প্রেমের ভেতর দ্রোহী-চেতনার মশাল জ্বেলে দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন-
‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’

পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে তিনি কবিতা লিখে কবি হয়ে জন্মগ্রহণ না করলে আমরা তাঁকে কস্মিনকালে কখনও হয়তো চিনতে পারতাম না। এখানেই তিনি একজন সফল ও সার্থক মানুষের বিমূর্ত প্রতীক। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে বাংলাসাহিত্যের জন্য যা রেখে গেছেন, তা চিরকালের অমূল্য সম্পদ হয়ে রইল।

কবি ও সংগঠক
২৪.০৫.২০২৩