
ইদানিং বাঙ্গালির হৃদয়ে সবচেয়ে ভাল পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে প্রবাস। মনে হচ্ছে অর্থ উপার্জনে এরচেয়ে ভাল রাস্তা কি আর হয়? আবার বাংলাদেশও বেশ ভালই বৈদেশিক রেমিটেন্স পাচ্ছে। এই প্রবাস শুধুই ভাগ্য অন্বেষণ নয় , অনেকেরই এর সাথে মিশে আছে যে কোনোভাবে বিদেশে যাওয়ার নেশা বা স্বপ্ন।
আর এই প্রবাস জীবনটা যদি হয় ইউরোপে…! তবে তো আর কথায় নেই। ইউরোপ মানেই চোখের সামনে ভেসে উঠা প্যরিসের আইফেল টাওয়ার। চোখে লালিত লন্ডন ব্রিজ কিংবা সাদা বরফে ঢেকে যাওয়া বিস্তৃত শহরের অলি-গলি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বেছে নিচ্ছে অনেক তরুণ অবৈধ পথ। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়ার স্বপ্নে, মানব প্রচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ছেন দেশের অসংখ্য তরুণ-যুবক। তাদের অনেকেই দুর্গম এ যাত্রা পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের দেশে পা রাখার আগেই বেশিরভাগের স্বপ্নই দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। মানবপ্রাচারকারীদের হাতে কেউ হচ্ছেন নির্যাতিত।কেউ মৃত লাশ হয়ে ফিরছেন দেশে।কেউবা ডুবে তলিয়ে যাচ্ছেন রাক্ষসী গভীর সাগরের তলদেশে। তবুও এ স্বপ্ন নামের দুঃস্বপ্ন দেখেই যাচ্ছেন বাঙ্গালিরা।
সম্প্রতি মিডিয়া আলোচিত লিবিয়ার মিজদা শহরে ২৬ জন বাঙ্গালির জীবনের ইতি ঘটলো এই দুঃস্বপ্নের পথ পাড়ি দিতে গিয়ে। যাদের অধিকাংশই আবার আমাদের কিশোরগঞ্জের ভৈরবের। গত বৎসরও নৌকাডুবিতে ৩৭ জন নিহত হয়ে হারিয়েছেন ভূমধ্যসাগরে প্রতিবৎসর এভাবে নানা বিপদের ঝুঁকির খবর প্রকাশ পেলেও থেমে নেই বাঙ্গালির এ স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রা। নানা অবৈধ উপায় বেছে নিয়ে প্রতিনিয়তই তারা পাড়ি জমাতে চাচ্ছে ইউরোপ অঞ্চলে।
এতসব মৃত্যুর পরও বাঙ্গালিরা জীবনের ঝুঁকি কেন নিচ্ছে? এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকা লাকমিনা জেসমিন সোমার একটা আর্টিকেল বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে।তিনি এর পিছনে দুটি কারণ বেছে নিচ্ছেন।
প্রথমত, মানবপ্রাচারকারী চিহ্নিত দালালদের অপতৎপরতা বন্ধে সরকারের কার্যকারী কোন প্রদক্ষেপ নেই।সেই সাথে চিহ্নিত মানবপ্রাচারকারীদের শাস্তিও হচ্ছেনা।
দ্বিতীয়ত,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা উপায়ে, নানাজনে শুধুমাত্র এ প্রবাস জীবনের সফলতার গল্পের প্রচারই চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু এ সফরের মর্মান্তিক ভয়াবহ চিত্র মানুষের কাছে খুব কমই প্রচার হচ্ছে।
দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব ও সহজেই অর্থউপার্জনের একমাত্র রাস্তা এখন প্রবাস। প্রবাসের অধিকাংশের জীবনই দুঃসহ। একটুখানী সুখের আশায় ভিটে বাড়ি বন্ধক রেখে আসা মানুষগুলো নিরবে, নিভৃতে দূর-পরবাসে চোখের অশ্রুজলে সিক্ত হয়। যারা এই প্রবাসে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে অল্প আয় করে, তাদের দীর্ঘশ্বাস জানে, তাদের ঘাম জানে, তাদের শরীর জানে প্রবাস জীবন কী? শ্রম কী! নিরলস কাজ করে যাওয়া প্রতিটি প্রবাসী শ্রমিকের ভোর হয় দেশে ফিরে যাবে এই স্বপ্ন নিয়ে।
কিন্তু সময়ে- অসময়ে শ্রমিকদের নির্যাতন আর মৃত্যুর খবর শুনে আমাদের ভাবনার আকাশে অশনি সংকেতে উদয় হয়। এমনকি উর্ধ্বতন মহল কতৃক বারবার কুটুক্তিমূলক বাক্যচার ও শ্রমিকদেরকে বিমানবন্দরে এমনভাবে হয়রানি করা হয়, যেন এরা মানুষ না। যাদের মানুষ ভাবা হয় তারা হলো ভিআইপি।
বিডি নিউজের তথ্যনুসারে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাসে (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি) এক হাজার ৩০ কোটি (১০.৩৬ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দুঃখজনক হলেও সত্য এই রেমিটেন্স যোদ্ধারা আজও ভিআইপি হতে পারলেন না।দেশকে উন্নত করা রেমিটেন্স যোদ্ধারা কবে ভিআইপি হবে?
সুলতান আফজাল আইয়ূবী
কবি ও গণমাধ্যমকর্মী
nobosur15@gmail.com