সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:২৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
বীরকন্যা প্রীতিলতার আত্মদান দিবস
Update : শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৯ অপরাহ্ণ

সুলতান আফজাল আইয়ূবী

প্রীতিলতা বিপ্লবীদের প্রেরণার ঘর। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।  ১৯৩০ এর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৩২ সালে তার নেতৃত্বেই ইওরোপিয়ান ক্লাবে হামলা চালিয়েছিল বিপ্লবীরা। ব্রিটিশদের হাতে মরবেন না বলে শেষপর্যন্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিলেন প্রীতিলতা।

১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের বর্তমান পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভাদেবী। চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর স্কুলের মেধাবী ছাত্রী প্রীতিলতা ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করেন। ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে ১৯৩০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সমগ্র ঢাকা বোর্ডে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তার সঙ্গী বীণা দাশগুপ্তর পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে তাদেরকে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

প্রীতিলতা চট্টগ্রামের অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ঢাকার বিপ্লবী দল ‘দীপালী সংঘ’ এবং কলকাতার ‘ছাত্রী সংঘে’র সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। সূর্যসেন সহ অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে প্রীতিলতার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। বিপ্লবীদের জন্য তাঁরা অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহ করতেন। ঝাঁসির রাণীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অসীম সাহসী প্রীতিলতা ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে সূর্যসেনের নির্দেশে কয়েকজন বিপ্লবী সহযোদ্ধা সহ পূর্ণ সামরিক বেশে চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে অবস্থিত তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে যান। চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে ইউরোপীয়ান ক্লাব ছিলো ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতো। পাহাড়ে ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গ ও ক্লাবের কর্মচারীরা ছাড়া আর কেউ ধারে কাছে যেতে পারতো না। সেখানে লিখা ছিল, ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা যেসব কর্মসূচী নিয়েছিলেন, তারমধ্যে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ অন্যতম ছিল। বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে- শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজাত জানুক, এ দেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছনে নেই”। অতঃপর সূর্যসেন সিদ্ধান্ত নেন আক্রমণের দায়িত্ব একজন নারীকে দেবেন।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিয়ে গোপন বৈঠকে বসেন এবং জানিয়ে দেন তোমার নেতৃত্বে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত্রিতে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে। আক্রমণের পূর্বে কয়েকদিন পর্যন্ত প্রীতিলতা তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে অস্ত্রশিক্ষা নেন। অবশেষে ঠিক করেন ২৩ সেপ্টেম্বর রাত্র দশটায় ক্লাব আক্রমণ করবেন। সিদ্ধান্তানুযায়ী প্রীতিলতা তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ক্লাবের বাবুর্চির সংকেত পেয়ে রিভলবারের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যায় গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করে। উদ্দাম বিদেশী দল নৃত্যের মধ্যে নেমে এলো মৃত্যুর হাহাকার আর ধ্বংসলীলা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রীতিলতা তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করে হুইসেল দিয়ে সকলকে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন। সকলকে সামনে পাঠিয়ে ক্লাবের বাইরে নালার পাশ দিয়ে প্রধান সড়কে ওঠে। ঐ পথ গিয়ে মিলেছে রেলের ওভার ব্রীজে এবং সেটা পার হয়ে গেলে পাহাড়তলী বাজার। এমন সময় নালার মধ্যে থেকে একটি গুলি এসে প্রীতিলতার বুকে লাগতেই তার রক্তাক্ত দেহ রাস্তার ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে। রক্তস্রোতে প্রীতির স্বাভাবিক পোশাক ভিজে সামরিক পোশাকও রক্তরঞ্জিত হয়ে উঠে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে যন্ত্রণাকাতর প্রীতিলতার মনে হল, এমন আহত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা পড়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। প্রীতিলতা তার পকেট থেকে বিষের মোড়কটি খুলে নিজের মুখের মধ্যে ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দেহ তার হয়ে যায় নিথর নিশ্চল। প্রীতিলতার এই আত্মদান যুগ যুগ ধরে দেশপ্রেম আর সাহসিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহরে অকুতভয়ী বীরকন্যা প্রীতিলতা মৃত্যুবরণ করেন।

এরকম কোনো অভিযানে অনেকসময় সৈনিকদের সাথে পটাসিয়াম সায়ানাইড (তীব্র বিষ) দিয়ে দেওয়া হয়। যদি এমন পরিস্থিতি আসে, যখন সে শত্রুর কাছ ধরা পড়ে যাচ্ছে- তখন তার কাজ হচ্ছে, নিজের কাছে থাকা অস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা করা। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ওই পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে ফেলা। অত্যাচারে মুখে দলের কোনো গোপন তথ্য যাতে বলে না ফেলে, তাই এই ব্যবস্থা। অর্থাৎ, আহত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা না পড়ে আত্মহত্যা করা। প্রীতিলতাও সেই মুহূর্তে পালাবার কোনো উপায় না দেখে পটাসিয়াম সায়ানাইডটা মুখের মধ্যে ঢেলে দেন, জীবিত ধরা পড়ার ভয়ে।

মাত্র ২১ বছরের জীবনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যে দেশপ্রেম, ত্যাগ এবং সংগ্রামী আন্দোলনের উদাহরণ রেখে গেছেন তা ভারত উপমহাদেশের সকল মানুষের জন্য অনুস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তার আত্মবলিদান দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
পাকুন্দিয়া প্রতিদিন

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
আমাদের ফেইসবুক পেইজ