সালাতুল ঈদের আহকাম ও ফাযায়েল।
ঈদের পরিচয়ঃ
ঈদ আরবী শব্দ, এর আভিধানিক অর্থ হল খুশি।
রমজান পরবর্তী ঈদুল ফিতরে ক্ষমার ঘোষনা ও ঈদুল আযহায় কুরবানীর পশুর বিনিময়ে অগণিত নেকী প্রাপ্তিতে খুশি হয় মুমিনের হৃদয়, তাই এই খুশিকে ঈদ বলে।
ঈদের সূচনাঃ
হযরত আনাস (রা.) বলেন, মদিনায় নবী (স.) হিজরত করে আসার পর দেখলেন, মদীনাবাসী দুই দিন খুব আনন্দ উৎসব করে, তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুদিনে তোমরা কী কর?
তারা বললো আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগে এদুটো দিন খেলাধুলা ও আমোদ-ফুর্তি করতাম।
নবী (স.) বললেন,
আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এ দুটো দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন প্রদান করেছেন, তার একটি হলো ঈদুল আযহার দিন ও অপরটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন, সনানু আবী দাউদ, হাদিস নং-১১৩৬।
ঈদের নামাযে বিধানঃ
দ্বিতীয় হিজরীতে ঈদের নামায ওয়াজিব হয়।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, ঈদের নামাযের বিধান নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূল (স.) মৃত্যু পর্যন্ত কোন বছরই কোন ঈদের নামায পড়া বাদ দেননি, তেমনিভাবে খুলাফায়ে রাশিদীনের কেউ তা বাদ দেননি।
এর দ্বারা ঈদের নামায ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করলে গুনাহাগার হবে।
ঈদের নামাযের তারিখঃ
রমজান শেষে ১ লা শাওয়াল ঈদুল ফিতরের নামায পড়া ওয়াজিব, তবে যুক্তিসঙ্গত ওজর থাকলে পরের দিন পড়া যাবে।
অবশ্য ঈদুল আযহার নামায ওজর থাকলে পরবর্তী দুদিন পর্যন্ত পড়া জায়েয আছে।
ঈদের নামাযের সময়ঃ
সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বী-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত।
ঈদের নামাযের স্থানঃ
উভয় ঈদের জামাত ঈদগাহে পড়াই উত্তম।
অবশ্য মসজিদে পড়ে নিলেও ঈদের নামায আদায় হয়ে যাবে, তবে বিনা ওজরে মসজিদে ঈদের নামায না পড়া ভাল।
সুনানে আবি দাউদ হাঃনং-১১৬২.
সালাতুল ঈদের ফযীলতঃ
ঈদের দিন ও এর আগের রাত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
এই দিন ও রাত্রির মর্যাদার কথা বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ হয়েছে।
হযরত আইয়ুব আনসারী (রাঃ) বলেন, রাসুলে আকরাম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সকল ফিরিশতা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, হে মুসলিমগণ তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে আসো, উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সওয়াব প্রাপ্তির জন্য এগিয়ে আসো।
তোমাদের রাত্রিবেলার নামাজের নির্দেশ দেওয়া হলে তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামাজ পড়েছ, তোমাদের দিনগুলোতে রোজা রাখতে বলা হলে তোমরা সে নির্দেশও পালন করে একমাস রোজা রেখেছ।
এখন গরীব দুঃখীদের পানাহারের মাধ্যমে এগুলোর প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ কর।
ঈদের নামাজ পড়ার পর ফিরিশতাগণের মাঝে একজন ঘোষণা দেন, হে নামাজ আদায়কারীরা তোমাদেরকে মহান আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন।
অতএব সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও।
আর শোন, এ দিনটি হচ্ছে পুরস্কার প্রদানের দিন, আকাশে এ দিনের নামকরণ করা হয়েছে পুরস্কারের দিন (তাবারানী)।
সালাতুল ঈদের মাসায়েলঃ
ঈদের নামায জামাতের সাথে পড়া ওয়াজিব, তাই যথা-সম্ভব চেষ্টা করতে হবে, যেন ঈদের নামায পড়া যায়।
ঈদের নামাযের জন্য শর্ত তা’ই, যা জুমআর নামাযের জন্য শর্ত।
পার্থক্য শুধু জুমআর নামাযের আগে খুতবা পড়া ফরজ, আর ঈদের নামাযের পর খুতবা পড়া সুন্নত।
ঈদের নামায স্বাভাবিক অবস্থায় মাঠে পড়ারই বিধান।
ঈদের জামাত মাঠে আদায় করা সুন্নত। ওজর ছাড়া মাঠ বর্জন করা সুন্নাতের খেলাফ।
তবে কোন ওজরের কারণে মসজিদে বা অন্যকোন স্থানে আদায় করাতে কোন সমস্যা নেই।
যেহেতু সরকারী নির্দেশনা মোতাবিক মাঠে ঈদ আদায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই এলাকার মসজিদগুলোতে ঈদের নামায আদায় করবে।
এছাড়া কোন খোলা ময়দানে সকলকে জানিয়ে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত করলেও তা আদায় হয়ে যাবে, যদি ঈদের নামায শুদ্ধ হবার যাবতীয় শর্তের দিকে খেয়াল রাখা হয়। যেহেতু একই শহরে একাধিক স্থানে ঈদের জামাত পড়া জায়েজ আছে।
সহীহ বুখারী ১/৩১ হাদিস নং-৯৪৬. দুররে মুখতার-৩/৯. তাতারখানী-২/১১. উমদাতুল কারী-৬/৮১. রদ্দুল মুহতার-৩/৯।
এবং ওজরের কারণে এক মসজিদে একাধিক ঈদের জামাত ও শুদ্ধ হবে। ফাতাওয়া কাসিমিয়া- ৯/ ৪৯০, ফাতাওয়া রহীমিয়া-৬/১৫৩, ফাতাওয়া উসমানী-১/৫৫২.।
কোন দেশ বা এলাকায় যদি কোন কারণে ঈদের জামাত নিষিদ্ধ করে, তাহলে দুই বা চার রাকাত নফল নামাজ ঘরেই পড়ে নিবে, এবং এটি ঈদের নামাযের বিকল্প নয়, সূতরাং না পড়লেও কোন সমস্যা নেই।
তবে কোনক্রমেই একাকীভাবে ঘরে বা মসজিদে ঈদের নামাজ পড়া যাবেনা।
যেহেতু ঈদের নামাজের কোন বিকল্প নেই এবং ঈদের জামাতের ও বিকল্প নেই।
হযরতে ইমাম শা’বী রহ. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেছেন যার ঈদের নামাজ ছুটে গেলো সে যেন চার রাকাত নফল পড়ে নেয়।
ই’লাউস সুনান-৮/১৯.রদ্দুল মুহতার-২/৭৫. বাহরুর রায়েক্ব-২ ৮৪।
ঈদুল ফিতরের দিন করণীয়ঃ
১) ঈদের দিন রোযা রাখা যাবেনা বরং রোজা রাখা নিষেধ, সহিহ বুখারী হাদীস নং- ১৮৫৫।
২) আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ যথাসম্ভব বেশি বেশি তাকবীর পাঠ করা।
৩) ঈদের নামাযের প্রতি যত্মশীল হওয়া, এবং ঈদুল ফিতরের নামায বিলম্বে পড়া সুন্নত, যাতে ঈদের দিন সকালবেলা ফিতরা বণ্টন করার সময় পাওয়া যায়।
৪) নামাযে যাওয়ার পূর্বে গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে সুগন্ধি ব্যাবহার করতঃ সাধ্যানুযায়ী সবচেয়ে সুন্দর কাপড় পরিধান করে ঈদগাহ অভিমুখে যাত্রা করবে, সূরা নূর-৩১।
৫) ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে কোন কিছু খাওয়া, সহিহ বুখারী।
৬) সম্ভব হলে এক রাস্তায় যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা, এবং ঈদ উপলক্ষে পরস্পরে শুভেচ্ছা বিনিময় করা, সাহাবী রাঃ ঈদ উপলক্ষে এই বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” আল্লাহ আমাদের এবং আপনাদের (ইবাদত-বন্দেগী) কবুল করুন। বায়হাকী-২/৩১৯-সনদ হাসান।
অনুরূপভাবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা-সাক্ষাত করে খোঁজ খবর নেওয়া কর্তব্য। সেই সাথে পাড়া প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর রাখতে হবে। দরিদ্রদের যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে, যাতে ঈদের আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত না হয়। আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করুন, আমিন।
লেখক : মুহাম্মাদ আব্দুল কাইয়ুম, ইসলামি চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট।