
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُون —َ
وَِ قَالَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
إِنّ الصّوْمَ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
আশা করি আপনারা সকলে সুস্থ থেকে পবিত্র মাহে রমজানে মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের আশায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, দুরুদ ও সালাম, ত্বওবা ইস্তিগফার, যিকির ও তিলাওয়াত এবং দান খায়রাতের পাশাপাশি তারাবীহ ও সিয়াম সাধনায় লিপ্ত আছেন।
আজকে মাহে রমজানের পবিত্র রক্ষায়, রমজান পরবর্তী করণীয় ও জুমআতুল বিদা বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
ইতিমধ্যে-ই আমরা পবিত্র রমজান মাসের শেষ জুমআ আদায়ের মাধ্যমে রমজান মাসকে বিদায় জানানো দ্বার প্রান্তে।
এ রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য রহমত বরকত মাগফিরাত ও নাজাত তথা সিয়াম, কিয়াম ও তাকওয়ার উপহার নিয়ে এসেছিল।
এখন ভেবে দেখার বিষয় যে, রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা আমরা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি।
এ মাসে আমরা তিনটি জুমআ অতিবাহিত করে এখন রমজানের সর্বশেষ জুমআকে বিদায় জানানোর দ্বার প্রান্তে।
জুমআতুল বিদার শিক্ষা হোক কুরআন নাজিলের মাসে কুরআনকে হৃদয়ে ধারণ করে আমলি জিন্দেগি গঠনের।
জুমাআতুল বিদা
জুমাআতুল বিদা বলা হয় পবিত্র রমজান মাসের শেষ জুমআকে। এমনিতেই জুমআ`র দিনটি সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে অধিক ফজিলতের দিন। তারপর আবার রমজানের শেষ দশকের মর্যাদা ও গুরুত্ব অত্যাধিক। তাই রমজানের শেষ জুমআর ফজিলত বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
তাছাড়া জুমআ`র নামাজ সম্পর্কে হজরত সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা জুমআর নামাজে উপস্থিত হও এবং ইমামের নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াও। কেননা যে ব্যক্তি জুমআর নামাজে সবার পেছনে উপস্থিত হবে, জান্নাতে প্রবেশ ক্ষেত্রেও সে সবার পেছনেই পড়ে থাকবে। (মুসনাদে আহমদ)
জুমআর দিনটিকে সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই দিনের ফজিলত ও মর্তবা অনেক বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সূর্যোদয় হওয়ার সবগুলো দিনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হলো জুমআ`র দিন। এই জুমআ`র দিনেই হজরত আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন এবং জুমআর দিনই তাকে জান্নাত দান করেন এবং জুমআর দিনেই তাকে জান্নাত থেকে এই দুনিয়ায় প্রেরণ করেন এবং কিয়ামতও এই জুমআর দিনেই অনুষ্ঠিত হবে। (মুসলিম)।
মূল কথা হচ্ছে, জুমঅার নামাজ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অতিশয় মর্যাদা ফজিলতপূর্ণ ইবাদত।
বহু মুসলমান একত্রিত হয়ে আল্লাহর সম্মুখে বিনীতভাবে সিজদায় অবনত হওয়ার এবং নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য অধিকতর মজবুত করার জন্য এটি একটি সামষ্টিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান। তাই রমজানের শেষ দশকে অনুষ্ঠিত শেষ জুমআ’য় কল্যাণ লাভে ব্রতী হই।
রমজানের শেষ দশকের শেষ জুমআ বা জুমআতুল বিদার নামাজ আদায় করে অফুরন্ত ছাওয়াব, রহমত, বরকত মাগফিরাত এবং জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য সর্বাগ্রে মসজিদে উপস্থিত হওয়া আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজান ও জুমআতুল বিদার ফজিলত ও মর্যাদা লাভে যথা সময়ে মসজিদে যাওয়ার তাওফিক দান করুন।
তবে আমাদের কে মনে রাখতে হবে ইসলামে জুমআতুল বিদা বলতে বিশেষ কোন এবাদত নেই।
বরং আমাতের প্রতিটা মুহুর্ত, প্রতিটা দিন, প্রতিটা সপ্তাহ, প্রতিটা মাস ও বছর এমনকি আমাদের পুরা জীবনটাই খুব দামী ও ফযীলতপূর্ণ।
আর সময়টা যদি রমজান মাস হয় তাহলে সেটা স্বর্ণ রৌপ্য হীরা জহরত এমনকি দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে বেশি দামী।
তাই রমজান মাস টাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে যেন আমার একটি সেকেন্ড ও অযথা নষ্ট না হয়।
মাহে রমাযানের ফযীলত ও বিশিষ্টতা সম্পর্কে কুরআন মাজীদের এই আয়াত সকলেরই জানা-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ ۚ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ ؕ
রমযান মাস, যাতে অবতীর্ণ হয়েছে কুরআন, মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে।
সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পাবে সে যেন এই মাস রোযা রাখে। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৫
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে, ‘যখন রমাযান এলো তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
قَدْ جَاءَكُمْ رَمَضَانُ، شَهْرٌ مُبَارَكٌ، افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنّةِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلّ فِيهِ الشّيَاطينُ، فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا، فَقَدْ حُرِمَ
মাহে রমাযান তোমাদের মাঝে এসে গেছে, এ এক বরকতময় মাহিনা, আল্লাহ তোমাদের উপর এ মাসের সিয়াম ফরয করেছেন। এই মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়।
আর শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এতে আছে এমন এক রজনী, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে সে তো প্রকৃতই বঞ্চিত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭১৪৮
রমযান হল ঈমান-আমলের উন্নতি ও তাকওয়া হাসিলের এক মোক্ষম সময়। এটি পুরো বছর গুনাহ বর্জন, ইবাদতের শক্তি সঞ্চয় ও আত্মিক পাথেয় সংগ্রহের এক মহা সুযোগ। ঐ ব্যক্তিই রমযান হতে কাক্সিক্ষত সুফল ও উপকার গ্রহণ করতে পারল, যে নিজের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারল। রমযান হতে অর্জিত পাথেয় নিজের জীবনে ধারণ করতে পারল। হতে পারল মুত্তাকী- যে কিনা আল্লাহর আনুগত্য ও তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছে।
বাস্তবেই রোযাদার তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়। নইলে রোযার ব্যাপারে সে এত সতর্ক কেন? এবং এই সতর্কতা লোক দেখানোর জন্য নয়; শুধুই আল্লাহর ভয়ে, আল্লাহর আনুগত্যে। তাই তো আল্লাহ বলেছেন-
إِنّ الصّوْمَ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ.
নিশ্চয় রোযা আমার জন্য, আর এর প্রতিদান স্বয়ং আমিই দিব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১
অতএব আসুন আমরা এই রমযান হতে অর্জিত পাথেয় নিয়ে এগিয়ে চলি। ঈমান-আমল ও আখলাক-চরিত্রে আরো উন্নত হই। আল্লাহ-আল্লাহর রাসূলের পূর্ণ অনুগত হয়ে আখেরাতের চির সফলতার দিকে এগিয়ে যাই।
রমযান কেন্দ্রিক মানুষের প্রকারভেদ
এক. যারা রমযানের পূর্বেও আল্লাহ তাআলার অনুগত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করতেন। রমযান মাসের আগমনে এর ফযীলত ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে নেক আমলের বিষয়ে আরো তৎপর হয়েছেন। তাদের প্রতি নিবেদন হল, তারা যেন রমযানের পরও রমযান থেকে অর্জিত পাথেয় নিয়ে আরো উদ্যমী হয়ে আল্লাহর আনুগত্য এবং ইবাদত-বন্দেগীতে অটল থাকেন, আরো উন্নতি সাধন করেন। রমযানে কৃত নেক আমলের ধারা জারি রাখেন।
দুই. যারা রমযানের পূর্বে ছিলেন গাফেল-উদাসীন। রমযানের আগমনে এর ফযীলত ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমলের প্রতি তৎপর হয়েছেন। তাদের প্রতি আহ্বান, তারা যেন রমযানের পর ইবাদত-বন্দেগী হতে পুনরায় গাফেল না হয়ে যান; বরং রমযানের নেক আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন এবং আজীবন এর উপর অটল-অবিচল থাকার চেষ্টা করেন। রমযানে আল্লাহ নেক আমলের যে তাওফীক দিয়েছেন একে জীবনে ধারণ করে নিজেকে ধন্য করেন।
তিন. যাদের অবস্থা এই যে, রমযান আগমন করল ও বিদায় নিল; কিন্তু তাদের উপলব্ধি ও জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন ঘটল না। এদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান হল, আপনি নিরাশ হবেন না; আপনার জীবন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। আখেরাতের পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি। ইনশাআল্লাহ আবার আপনার জীবনে রমযান আসবে। আসুন, হতাশা ঝেড়ে ফেলে অবিলম্বে আল্লাহর নিকট তাওবা করি এবং তাঁর আনুগত্যের পথে চলতে শুরু করি। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে তাঁর মাগফিরাত ও রহমতের চাদরে ঢেকে নেবেন।
যাইহোক, যারা রমযানের হক্ব আদায় করে যথাযথভাবে রোযা পালন করেছেন এবং তাকওয়া-পরহেযগারীর গুণে গুণান্বিত হয়েছেন, ইবাদত বন্দেগীতে অগ্রগামী হয়েছেন, তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, তাঁর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এর উপর আমৃত্যু অবিচল থাকার চেষ্টা ও দুআ করি।
আর যারা রমযানকে যথাযথ কাজে লাগাতে পারেননি তারা আগামীর জন্য দৃঢ় সংকল্প করি এবং আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমতের প্রত্যাশী হই।
প্রিয় পাঠক, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে রমযান মাস মহান আল্লাহর অনন্ত রহমত ও বরকতের সেই ঋতুরাজ বসন্তকাল, যাতে মহান স্রষ্টার পক্ষ হতে দয়া ও অনুগ্রহের নানা বাহানা অন্বেষণ করা হয়,
যে মাসে ঈমানের দৌলতে ধন্য মুমিনের উপর রহমতের বৃষ্টি মুষলধারায় বর্ষিত হয়।
যে মাসে ক্ষমাশীল প্রভূ স্বীয় বান্দাদের পাপ মোচনের লক্ষ্যে সর্বদা ক্ষমার দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন।
জানি না এ মসে কত অসংখ্য-অগণিত মানুষকে মাগফেরাত করে জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার শাহী ফরমান জারি করা হয়।
মহান আল্লাহর পক্ষ হতে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি, নূরের স্রোত আমাদের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রান্ত হয়, কিন্তু আমরা অজ্ঞতা-অন্ধতার কারণে তার মাহাত্ম ও গুরুত্ব বুঝি না। ফলে অতি বরকতপূর্ণ দামী মুহূর্তগুলোকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা, গাফিলতি ও যাচ্ছেতাইভাবেই নিঃশেষ করে দিতে দ্বিধা বোধ করি না।
হাদীসে বর্ণিত-‘ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যে রমযান মাস পেল তারপরও তার গুণাহ মাফ হল না।’ সবার জন্য ক্ষমার দুয়ার উন্মুক্ত থাকার এই বিশেষ সময়েও যে ব্যক্তি নিজের গুনাহ ক্ষমা করাতে পারে না তবে তার অর্থ হবে এটাই যে, সে ব্যক্তি নিজেকে খোদার রহমত হতে (নাউযুবিল্লাহ) নিজেকে স্বাধীন ও অমুখাপেক্ষী মনে করে।
আর এই বেপরোয়া মানসিকতাই সবচেয়ে বিপদজনক বস্ত্ত, যার ব্যাপারে হযরত জিবরাঈল আ. ধ্বংসের বদদুআ করলেন আর নবীয়ে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সমর্থনে আমীন বললেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের মজলিসে সেই ধরনের কিছু অন্যায়-অবহেলার বিষয় উল্লেখ করাই উদ্দেশ্য, যা আমরা এই মুবারক মাসেও অব্যাহত রাখি।
ভয় লাগে যে, আল্লাহ না করুক এই অবজ্ঞা-অবহেলার কারণে সেই ভয়াবহ হুমকি ও বদদুআর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে না যাই। (আল্লাহ এমন ফয়সালা না করুন)
রমযান মাসে আমাদের সবচেয়ে ব্যাপক ও সীমাহীন অনৈতিক কর্ম এটাই যে, এই মুবারক মাসে নিজেদের দুনিয়াবি চাহিদা ও খরচের পরিধি সঙ্কুচিত করার পরিবর্তে আরো অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি করে দেই।
ব্যবসায়ী মহোদয়গণ তো এই মাসকে বিশেষ উপার্জনের মাস ঘোষণা দিয়ে রাত-দিন সেই ধ্যানেই মগ্ন থাকেন। অনেক সময় এই ধ্যান-মগ্নতার কারণে নামাযও ‘কুরবান’ হয়ে যায়।
অন্যদিকে
‘ঈদের প্রস্ত্ততি’ আমাদের জন্য এখন একটা বড় ধরনের ফিতনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা ‘ঈদুল ফিতর’কে মুসলমানদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সর্বজনীন বাৎসরিক আনন্দের বিশেষ দিবস হিসেবে মনোনিত করেছেন। এমনকি এ বিষয়টিও শরীয়তে স্বীকৃত ও প্রমাণিত যে, এই দিনে কোনো উত্তম থেকে উত্তম পোশাক কেউ যদি সহজে লাভ করতে পারে সে যেন তা পরিধান করে।
কিন্তু বর্তমানে এ উপলক্ষে ‘উত্তম পোশাকের’ অজুহাতে যে অসীম-অগণিত বেহুদা খরচের জোয়ার সৃষ্টি করা হয়, অন্যায়-অপব্যয়ের যে মহা প্লাবণ বইয়ে দেওয়া হয় এবং সেটাকে ঈদের অপরিহার্য অনুষঙ্গ বলে মনে করা হয় তার সঙ্গে দ্বীন ও শরীয়তের কোনো সম্পর্ক নেই।
বর্তমান যুগে এ বিষয়টি ফরয-ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয়, (ঈদ পালনের জন্য) অতি আবশ্যকীয় জরুরি বিষয় মনে করা হয় যে, কোনো ব্যক্তির আর্থিক সচ্ছলতা থাকুক বা না থাকুক কিন্তু সে কোনো না কোনো উপায়ে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য নিত্য-নতুন ডিজাইন ও ফ্যাশনেবল পরিধেয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করবে। ঘরের প্রত্যেক সদস্যের জন্য জুতা-টুপি থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিস নতুন নতুন ক্রয় করবে।
শুধু তাই নয় ঈদের প্রকৃত স্বাদ অনুভবের জন্য, ঘরের সাজ-সজ্জা ও শোভাবর্ধনের জন্য নিত্য-নতুন আসবাবপত্র ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের ফার্নিচারের ব্যবস্থাও করা হয়।
দূর-দূরান্তে অন্যান্য শহরে বসবাসকারী আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের নিকট মূল্যবান গিফট ও দামি ঈদকার্ড প্রেরণ করা হয়।
আর এসব কাজ এমন এক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা নিয়ে সম্পন্ন করা হয় যে, কেউ যেন কারো থেকে পিছে পড়ে না যায়। কেউ যেন কারো কাছে কোনো ক্ষেত্রে হেরে না যায়।
এসবের অনিবার্য পরিণতি এটাই হয় যে, একজন মধ্যম স্তরের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জন্য ‘ঈদের প্রস্ত্ততি’ একটি বাড়তি দুশ্চিন্তা ও আলাদা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এরই ধারাবাহিকতায় যখন সে দেখে যে, হালাল উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারের সবার চাহিদা ও আবদার পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না এবং বৈধ টাকা-পয়সা তার জন্য পর্যাপ্ত হচ্ছে না, তখন সে অবৈধ পথের সন্ধান করে। বিভিন্ন পন্থায় অন্যের পকেট মেরে টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে। যা দ্বারা সেই লাগামহীন চাহিদা ও অন্তহীন কুপ্রবৃত্তির পেট ভর্তি করে।
এসব বাদ দিলেও ‘ঈদের প্রস্ত্ততি’র সবচেয়ে ন্যূনতম ক্ষতি তো এটাই যে, মহামূল্যবান ও বিশেষ করে শেষ দশকের রজনীগুলো-যা একান্ত নীরবে, নিরালা পরিবেশে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা ও মুনাজাতের শ্রেষ্ঠতম সময়, খোদার সান্নিধ্য লাভের মোক্ষম সুযোগ ও অনন্য মুহূর্ত, তা বাজারের মধ্যে অতিবাহিত হয়ে যায়।
এসব আলোচনার উদ্দেশ্য-আল্লাহ না করুন-কাউকে তিরস্কার করা, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা কিংবা সমালোচনার খাতিরে সমালোচনা করা নয়; বরং অন্তরের দরদ ও সহানুভূতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এ দাওয়াতী চিন্তা-চেতনা পেশ করা যে, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ মাস আল্লাহ তাআলা কোন্ কাজের লক্ষ্যে সৃষ্টি করলেন, কী উদ্দেশ্যে এমন একটি শ্রেষ্ঠ মাস দান করলেন। আর আমরা সেটাকে কোন্ বেহুদা কাজে ব্যয় করি। অনর্থকভাবে সেটাকে বিনষ্ট করি।
যদি আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদর্শিত পথ, শিক্ষা-দীক্ষা ও তার আদর্শের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও অনুরাগ থাকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফায়াত লাভের তপ্ত বাসনা অন্তরে জাগ্রত থাকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বদদুআকে সত্যিকারভাবেই বিপদজনক মনে করে ভয় করি তাহলে জামার আঁচলে মুখ ঢেকে আমাদের হিসাব করা উচিত এবং অতীত গাফিলতি হতে খাঁটি মনে তওবা করে এই অঙ্গীকার উচিত যে, এই পবিত্র মাসে সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকব। একনিষ্ঠ মনে আল্লাহর দিকে ফিরে আসব।
রমযানের এই অতি মূল্যবান সময়গুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির মধ্যেই ব্যয় করব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এ অঙ্গীকার পূরণ করার তাওফীক দান করুন।
সম্মানিত পাঠক, পরিশেষে ভাবতে হবে আমি কি রমযান থেকে পাথেয় গ্রহণ করতে পেরেছি?
রমযান মাসে গুনাহ বর্জন ও নেক আমলের যে অনুশীলন করেছি, তা থেকে কি জীবনের পাথেয় অর্জন করতে পেরেছি?
আমি কি সফল রোযাদার?
রোযার মাধ্যমে আল্লাহর ভয় ও তাঁর আনুগত্যের যে অঙ্গীকার আমি করেছি, তা কি ঠিক রাখতে পারছি?
কিছু লক্ষণ দ্বারা আমি নিজেকে যাচাই করে নিই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ :
ক. ঈদের দিন কি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেছি?
বা আমার কি জামাত ছুটে গেছে?
খ. ঈদের খুশীর নামে গান-বাদ্য, নাটক-সিনেমা ইত্যাদিতে মেতে উঠেছি? ইন্টারনেটের অপব্যবহার করেছি?
গ. ঈদ উপলক্ষে বেপর্দা, ফ্রি মিক্সিং ও বিনোদনের নামে বিভিন্ন পাপের অনুষ্ঠানে জড়িয়ে পড়েছি?
ঘ. রমযান-পূর্ববর্তী অলসতা-উদাসীনতা কি আবার আমাকে গ্রাস করছে?
প্রকৃত রোযাদার কিন্তু ঈদের দিন আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আদায় করে।
এই ভেবে খুশি হয় যে, সে দীর্ঘ এক মাস আল্লাহর হুকুম পালন করেছে এবং ইনশাআল্লাহ গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভ করেছে। আর সাথে সাথে সে এই ভয়েও ভীত থাকে যে, আমার আমল কি আল্লাহর দরবারে কবুল হল?
এজন্য সে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করতে থাকে, যাতে তিনি তার আমল কবুল করে নেন এবং তাকে তাঁর মুত্তাকী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
সুতরাং রমযানের আমল কবুল হওয়ার আলামত হল, বান্দা নিজেকে ঈমান-আমলের ক্ষেত্রে তার পূর্বের অবস্থার চেয়ে উত্তম অবস্থায় পাবে এবং সৎকর্মে আরো বেশি অগ্রগামী হবে।
সুতরাং মুমিন বান্দা শুধু মৌসুমভিত্তিক ইবাদত করেই ক্ষান্ত হবে না; বরং সর্বদা ইবাদত জারি রাখার চেষ্টা করবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ.
তুমি মৃত্যু অবধি তোমার রবের ইবাদত করতে থাক। -সূরা হিজর (১৫) ৯৯
রমযানোত্তর আমলের ধারাবাহিকতা ও আমাকে রক্ষা করতে হবে।
রমযান অতিবাহিত হয়ে গেলেও মুমিন সারা বছরই রমযানে কৃত আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। সারা বছর কীভাবে আমরা রমযানে কৃত আমলগুলোর ধারা চালু রাখতে পারি সে বিষয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হল।
১/
রোযা রাখার ধারা অব্যাহত রাখাঃ-
রমযানের রোযা শেষ হলেও অবশিষ্ট মাসগুলোতে বহু নফল রোযা রয়েছে। সামর্থ্য অনুযায়ী সেসব রোযা রাখার চেষ্টা করব। যেমন-
শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمّ أَتْبَعَهُ سِتّا مِنْ شَوّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدّهْرِ.
যে ব্যক্তি রমযান মাসের রোযা রাখল। অতপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন সারা বছর রোযা রাখল। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৪
প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তিন দিনের রোযা (আইয়ামে বীযের রোযা)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ثَلَاثٌ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، فَهَذَا صِيَامُ الدّهْرِ كُلِّهِ .
প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখা এবং রমযান মাসের রোযা সারা বছর রোযা রাখার সমতুল্য। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
অন্য বর্ণনায় আছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
صَوْمُ ثَلَاثَةِ أَيّامٍ مِنَ الشّهْرِ، صَوْمُ الشّهْرِ كُلِّهِ.
মাসে তিন দিন রোযা রাখা পুরো মাস রোযা রাখার সমান। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫৯
আর এ রোযা প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রাখা উত্তম। পরিভাষায় এ দিনগুলো ‘আইয়ামে বীয’ নামে পরিচিত। ‘বীয’ আরবী শব্দ, এর অর্থ : সাদা, উজ্জ্বল। প্রত্যেক চান্দ্রমাসের এ দিনগুলোতে যেহেতু চাঁদের আলো পূর্ণ উজ্জ্বল থাকে এজন্য এই তারিখগুলোকে ‘আইয়ামে বীয’ বলা হয়। হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হযরত আবু যর গিফারী রা.-কে লক্ষ্য করে বলেন-
يَا أَبَا ذَرٍّ، إِذَا صُمْتَ مِنَ الشّهْرِ ثَلَاثَةَ أَيّامٍ فَصُمْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ، وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ، وَخَمْسَ عَشْرَةَ.
قال الترمذي: ﺣﺪﻳﺚ ﺣﺴﻦ
হে আবু যর! তুমি যদি মাসে তিন দিন রোযা রাখ তবে তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখে রাখ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৬১
প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার রোযা রাখা
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ، فَأُحِبّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.
حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ فِي هَذَا البَابِ حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.
সোম ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, আমার আমল পেশ হোক এমতাবস্থায় যে, আমি তখন রোযাদার। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৭
আরাফার দিনের রোযা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ، وَالسَّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.
আরাফার দিনের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) বিগত বছরের এবং পরবর্তী বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
আশুরার রোযা
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, নবীঁজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ.
আশুরার রোযা সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এর দ্বারা তিনি বিগত বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
শাবান মাসে বেশি বেশি রোযা রাখা
শাবান মাসে অধিক পরিমাণে রোযা রাখা উত্তম। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন-
لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي الشّهْرِ مِنَ السّنَةِ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাস ব্যতীত বছরের অন্য কোনো মাসে এত অধিক (নফল) রোযা রাখতেন না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৮২
অন্য বর্ণনায় আছে, হযরত আয়েশা রা. বলেন-
وَلَمْ أَرَهُ صَائِمًا مِنْ شَهْرٍ قَطُّ، أَكْثَرَ مِنْ صِيَامِهِ مِنْ شَعْبَانَ كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ كُلّهُ، كَانَ يَصُومُ شَعْبَانَ إِلّا قَلِيلًا.
আমি তাঁকে শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে এত অধিক রোযা রাখতে দেখিনি। তিনি (যেন) গোটা শাবান মাসই রোযা রাখতেন। তিনি সামান্য (কয়টি দিন) ব্যতীত পুরো শাবান মাস রোযা রাখতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৮১.
২/
নফল নামাযের ধারা অব্যাহত রাখা।
রমযানের দীর্ঘ তারাবীহর নামায শেষ হয়েছে। এই তারাবীহ দ্বারা লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থেকে একসাথে অনেক রাকাত নামায আদায় করার একটা ভালো অভ্যাস সৃষ্টি হয়েছে। এই অভ্যাস পুরো বছরই রক্ষা করা উচিত। নিম্নে এ আমলের ধারাবাহিকতা রক্ষার কয়েকটি ক্ষেত্র উল্লেখ করা হল।
ক. কিয়ামুল লাইল
কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ নামায রমযান ও রমযানের বাইরে সারা বছরের নফল নামায। তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফযীলত প্রসঙ্গে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أَفْضَلُ الصّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.
ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম (নফল) নামায হল, রাতের নামায তথা তাহাজ্জুদ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩
খ. সুন্নাতে রাতেবা
দৈনিক ফরয নামায সংশ্লিষ্ট ১২ রাকাত সুন্নতে মুআক্কাদাহ নামায আদায় করা। যথা, যোহরের পূর্বে চার রাকাত, পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পর দুই রাকাত, এশার পর দুই রাকাত এবং ফজরের পূর্বে দুই রাকাত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ صَلّى اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً فِي يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، بُنِيَ لَهُ بِهِنّ بَيْتٌ فِي الْجَنّةِ.
যে ব্যক্তি দিবারাত্রিতে ১২ রাকাত (সুন্নত) নামায আদায় করবে, বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৮
গ. ইশরাক/চাশত
প্রতিদিন সকালে দুই/চার রাকাত ইশরাকের নামায পড়া। সূর্যোদয়ের প্রায় ১০/১৫ মিনিট পর থেকে এই নামায পড়া যায়। এর ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত আছে। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
ابْنَ آدَمَ ارْكَعْ لِي أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ مِنْ أَوّلِ النّهَارِ أَكْفِكَ آخِرَهُ.
قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.
হে আদম সন্তান! তুমি দিনের শুরুতে আমার জন্য চার রাকাত নামায আদায় কর, আমি পুরো দিন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাব। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৭৫
অন্য এক হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ صَلّى الغَدَاةَ فِي جَمَاعَةٍ ثُمّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللهَ حَتّى تَطْلُعَ الشّمْسُ، ثُمّ صَلّى رَكْعَتَيْنِ كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجّةٍ وَعُمْرَةٍ .
قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.
যে ব্যক্তি জামাতে ফজরের নামায আদায় করে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে আল্লাহর যিকির করতে থাকে, এরপর (পূর্ণ সূর্যোদয় হলে) দুই রাকাত (নফল) নামায আদায় করে, সে ব্যক্তি এক হজ্ব ও এক উমরা আদায়ের সওয়াব পাবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৮৬
রৌদ্রতাপ কিছুটা বাড়লে আরেকটি নফল নামায আছে। তা হল সালাতুয যুহা বা চাশতের নামায। দুই রাকাত পড়ে নিলেও এই নামাযের সওয়াব হাসিল হতে পারে।
ঘ. তাহিয়্যাতুল অযু
দুই রাকাত করে তাহিয়্যাতুল অযু ও দুখূলুল মাসজিদ নামায নিয়মিত অনায়াসেই আদায় করা যায়। অযু করার পর মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে বিলম্ব না করে দুই রাকাত নামায পড়া ম্স্তুাহাব। এই নামাযকে ‘তাহিয়্যাতুল অযু’ বলা হয়। হাদীস শরীফে এই নামাযের অনেক ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ يَتَوَضّأُ فَيُحْسِنُ الْوُضُوءَ، ثُمّ يَقُومُ فَيَرْكَعُ رَكْعَتَيْنِ، يُقْبِلُ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ، إِلّا قَدْ أَوْجَبَ.
তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অযু করবে। অতপর দেহ-মন (আল্লাহর দিকে) ধাবিত করে দুই রাকাত নফল নামায পড়বে, সে (যেন) নিজের জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে নিল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬৯
অন্য হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ تَوَضّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هَذَا، ثُمّ صَلّى رَكْعَتَيْنِ لاَ يُحَدِّثُ فِيهِمَا نَفْسَهُ، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.
যে ব্যক্তি আমার এই অযুর মত অযু করবে, তারপর দুই রাকাত নামায আদায় করবে, যাতে (দুনিয়ার) কোনো খেয়াল করবে না, তার পেছনের সকল (ছগীরা) গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯
ঙ. তাহিয়্যাতুল মাসজিদ
মসজিদে প্রবেশ করে সময় থাকলে বসার পূর্বে এবং মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে অন্তত দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামায আদায় করা মুস্তাহাব। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ المَسْجِدَ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يَجْلِسَ.
তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, সে যেন বসার পূর্বে দুই রাকাত নামায আদায় করে নেয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪৪.
৩/
যিকিরের ধারা অব্যাহত রাখা।
হাদীস শরীফে বর্ণিত বিভিন্ন সময় ও মুহূর্তে পঠিতব্য মাছূর দুআ ও যিকির, নামাযের পরে ও সকাল-সন্ধ্যার ফযীলতপূর্ণ তাসবীহ ও যিকিরসমূহ নিয়মিত পাঠ করা।
৪/
দুআর ধারা অব্যাহত রাখা।
দুআ মুমিনের জীবনের অনেক বড় হাতিয়ার। এর মাধ্যমে সে আল্লাহর নিকট থেকে সবকিছুই আদায় করে নিতে পারে। আর দুআ কবুল হওয়ার বিষয়টি শুধু রমযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
মুমিনের বৈধ কোনো দুআই আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। বিলম্বে হলেও বা ভিন্নরূপে কিংবা পরকালের সঞ্চয়রূপে তা কবুল করে থাকেন। এছাড়া রমযানের বাইরেও দুআ কবুল হওয়ার বিশেষ কিছু সময় রয়েছে। যেমন, শেষ রাতে, ফরয নামাযের পর, আযান ও ইকামতের মাঝে, জুমার দিন, কুরআন মাজীদ খতমের পর ইত্যাদি। সুতরাং সাধারণ ও বিশেষ সময়গুলোতে বেশি বেশি দুআর মাধ্যমে দোজাহানের যাবতীয় কল্যাণ হাসিল করে নেয়া উচিত হবে।
৫/
কুরআন তিলাওয়াতের ধারা অব্যাহত রাখা।
কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ও মর্যাদাসম্বলিত একটি আমল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ﻣَﻦْ ﻗَﺮَﺃَ ﺣَﺮْﻓًﺎ ﻣِﻦْ ﻛِﺘَﺎﺏِ ﺍﻟﻠﻪِ ﻓَﻠَﻪُ ﺑِﻪِ ﺣَﺴَﻨَﺔٌ، ﻭَﺍﻟﺤَﺴَﻨَﺔُ ﺑِﻌَﺸْﺮِ ﺃَﻣْﺜَﺎﻟِﻬَﺎ، ﻟَﺎ ﺃَﻗُﻮﻝُ ﺍﻟﻢ ﺣَﺮْﻑٌ، ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﺃَﻟِﻒٌ ﺣَﺮْﻑٌ ﻭَﻟَﺎﻡٌ ﺣَﺮْﻑٌ ﻭَﻣِﻴﻢٌ ﺣَﺮْﻑٌ .
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻱ : ﻫَﺬَﺍ ﺣَﺪِﻳﺚٌ ﺣَﺴَﻦٌ ﺻَﺤِﻴﺢٌ ﻏَﺮِﻳﺐٌ ﻣِﻦْ ﻫَﺬَﺍ ﺍﻟﻮَﺟْﻪِ .
যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করল, তার বিনিময়ে সে একটি নেকী লাভ করল। উক্ত একটি নেকি দশটি নেকীর সমতুল্য গণ্য করা হবে। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মিম’ একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ এবং ‘মীম’ একটি হরফ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১০
অর্থাৎ অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রে যেমন পুরো আমলকে একটি বলে গণ্য করা হয়, কুরআনের ক্ষেত্রে সেরূপ নয়; বরং এখানে প্রতিটি হরফের পরিবর্তে একটি করে নেকী হবে। আর প্রতিটি নেকীর বিনিময়ে দশটি করে নেকী পাওয়া যাবে।
কুরআন আল্লাহর কাছে পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
ﺍﻗْﺮَﺀُﻭﺍ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﻓَﺈِﻧّﻪُ ﻳَﺄْﺗِﻲ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﺷَﻔِﻴﻌًﺎ ﻟِﺄَﺻْﺤَﺎﺑِﻪِ .
তোমরা কুরআন পাঠ করো। কেননা তা কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্য সুপারিশ করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮০৪
কুরআনে কারীম কী বলে পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে- হাদীস শরীফে তাও বর্ণিত হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
ﺍﻟﺼِّﻴَﺎﻡُ ﻭَﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥُ ﻳَﺸْﻔَﻌَﺎﻥِ ﻟِﻠْﻌَﺒْﺪِ ﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ، ﻳَﻘُﻮﻝُ ﺍﻟﺼِّﻴَﺎﻡُ : ﺃَﻱْ ﺭَﺏِّ ﻣَﻨَﻌْﺘُﻪُ ﺍﻟﻄّﻌَﺎﻡَ ﻭَﺍﻟﺸّﻬَﻮَﺍﺕِ ﺑِﺎﻟﻨّﻬَﺎﺭِ ﻓَﺸَﻔِّﻌْﻨِﻲ ﻓِﻴﻪِ . ﻭَﻳَﻘُﻮﻝُ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥُ : ﻣَﻨَﻌْﺘُﻪُ ﺍﻟﻨّﻮْﻡَ ﺑِﺎﻟﻠّﻴْﻞِ ﻓَﺸَﻔِّﻌْﻨِﻲ ﻓِﻴﻪِ . ﻗَﺎﻝَ : ﻓَﻴُﺸَﻔّﻌَﺎﻥِ .
রোযা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলায় খানাপিনা ও প্রবৃত্তির চহিদা পূরণ হতে বিরত রেখেছি। কাজেই তার বিষয়ে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, হে আল্লাহ! তাকে আমি রাত্রি বেলায় নিদ্রা হতে বিরত রেখেছি। কাজেই আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৮৯
কুরআন তিলাওয়াতের উক্ত ফযীলত সবসময়ের জন্য; শুধু রমযানের জন্য নয়। তাই তিলাওয়াতের ধারাবাহিকতা পুরো বছর, প্রতিদিনই জারি রাখা উচিত।
৬/
দান-সদকার ধারা অব্যাহত রাখা।
রমযানে যাকাত, সাদাকাতুল ফিতর এবং অন্যান্য দান-সদকার আমল শেষ হলেও সারা বছর এ আমলের দ্বার উন্মুক্ত। যাকাত ও সাধারণ দান-সদকা রমযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গোটা বছরই এর সময় এবং তা সবসময়ই ফযীলতপূর্ণ আমল। অতএব সামর্থ্য অনুযায়ী সারা বছরই দান-সদকার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা উচিত। কেননা দান-সদকার দ্বারা সম্পদ হ্রাস পায় না; বরং বৃদ্ধি হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ.
আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-সদকাকে বৃদ্ধি করেন। -সূরা বাক্বারা (২) : ২৭৬
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ.
দান-সদকা সম্পদ হ্রাস করে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৮
অপর এক হাদীসে আছে, দানকারীর জন্য ফেরেশতাগণ প্রত্যহ সম্পদ বৃদ্ধির দুআ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلّا مَلَكَانِ يَنْزِلَانِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا: اللّهُمّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا وَيَقُولُ الْآخَر: اللّهُمّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا.
প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা আসমান থেকে অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! সম্পদ ব্যয়কারীকে (দানকারীকে) তার বদলা (আরো সম্পদ) দাও। অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! (দান না করে) যে সম্পদ ধরে রাখে তার সম্পদ ধ্বংস করে দাও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪২
অতএব হে সম্মানিত সুধী ও পাঠকবৃন্দ,
আসুন, এভাবে সারা বছরের জন্য নেক আমলের ধারা চালু রাখি, অলসতা বর্জন করি। গুনাহমুক্ত জীবন-যাপনের অভ্যাস গড়ে তুলি। আল্লাহ তাআলা সবাইকে ঈমানের উপর দৃঢ় রাখুন, নেক আমলের তাওফীন দান করুন।
আমিন। ِ
লেখক : মুহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট।