দেশ ও জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে প্রয়োজন বায়োটেকনোলজিস্ট, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার, বায়োক্যামিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্টদের যারা কোন মাইক্রোঅর্গানিজমের চৌদ্দ গোস্টি উদ্ধারে সিদ্ধহস্ত। মাইক্রোঅর্গানিজম থেকে হিউম্যান- যেকোন জিনের ফাংশন এনালাইসিস করার সক্ষমতা আমাদের এসব লাইফ সাইন্স গবেষকদের আছে। ভ্যাক্সিন বা কোন স্পেসিফিক ড্রাগ লিগান্ড প্রেডিকশন বা আবিস্কার ওনাদের হাত ধরেই হয়। ক্যান্সারসহ যেকোন দূরারোগ্য রোগের জেনেটিক মেকানিজম আমাদের মলিকিউলার বায়োলজিস্টরাই খোঁজে বের করতে পারেন। আমরা এখন মিডিয়াতে আরটি পিসিআর এর নাম শুনেছি যা দ্বারা করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণ করা যাবে খুব সহজে। মিডিয়াতে যেভাবে বড় বড় পেকেট দেখিয়ে বলছযে আরটি পিসিআর মেশিন কেনা হয়েছে, যে কেউ মনে করবে মেশিনটি না জানি কত বড়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মেডিকেল কলেজ গুলোতে বেশিরভাগ ডাক্তার (যারা মলিকিউলার গবেষণার সাথে যুক্ত নয়) আরটি পিসিআর মেশিন চালাতে পারবেন না -এটা আমি হলপ করে বলতে পারি। কিন্তু মলিকিউলার বায়োলজিস্টদের কাছে এ মেশিন নিয়ে কাজ করা পানি ভাতের মত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে জিনবিদদের নিয়োগ দেয়া হয়। কোন রোগ নির্ণয়ে ডাক্তারদের দ্বারা গঠিত বোর্ডে জিনবিদরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
আমাদের দেশে বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান, পাট ও মৎস গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে; সেখানে মলিকিউলার ল্যাবরেটরি রয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে সেখানকার বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা ল্যাবগুলোকে ব্যবহার করতে জানেন না। হ্যাঁ হাতে গোনা যারা দেশের বাহির থেকে মলিকিউলার বায়োলজির উপর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন তারাই মূলত এ ল্যাবগুলো ব্যবহার করতে পারেন। কেন এই অবস্থা? উত্তর খুব সহজ!! এসব প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয় বিসিএস এর মাধ্যমে। যাদের ব্যাক-গ্রাউন্ড উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণি বিজ্ঞান, ফরেস্ট্রি, সমুদ্র বিজ্ঞান, মৎস বিজ্ঞান তারা মূলত নিয়োগ পান, যেখানে বায়োটেকনোলজিস্ট বা মলিকিউলার বায়োলজিস্টের কোন সুযোগই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমার মনে হয় না এসব ডিপার্টমেন্টগুলোতে মলিউকিলার বায়োলজি ব্যবহারিকসহ পড়ানো হয়, গবেষণা তো দূরের কথা! ওনারা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে পিসিআর, জেলডক, জেল-ইলেকট্রফরেসিস, এইচপিএলসি ইত্যাদি মৌলিক যন্ত্রপাতি কিভাবে ব্যবহার করবেন আমার বুঝে আসে না। আর যারা পাঁচ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে কঠোর পরিশ্রম করে বিসিএস এর কথা চিন্তা না করে গবেষণা কে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে তারা দেশে বসে আঙ্গুল চুসবে- এটা তো হতে পারে না। আমাদের পলিসি মেকারদের ভুলের কারণে লাইফ সাইন্সের এসব রত্মদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না যা খুবই কস্টকর। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির এ ক্রান্তিলগ্নে যেসব লাইফ সাইন্স গবেষকরা বেকার সময় কাটাচ্ছেন তাদের কস্ট সবার না বুঝে আসলেও আমি বুঝি। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বিশ্বে এদের চাহিদা বেড়ে যাবে। এদেরকে দেশে রাখা তখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। অনেক সময় আমার মনে হয়, বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা মলিকিউলার বায়োলজি পড়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমার বুঝে আসে না সরকার উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে এসব ব্যাক-গ্রাউন্ডের গ্রেজুয়েটদের নিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব ডিপার্টমেন্ট কেন খুলল! হয়তো উপর মহল থেকে উত্তর আসবে আবেগে, খুশিতে ও ঠেলায়!!- এছাড়া আর কিছু নয়।
গত বছরের আগস্টে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট আব বায়োটেকনোলজিতে একটা ট্রেনিং এর জন্য যাওয়া হয়েছিল। খুব বড় বড় ল্যাব দেখে ভালই লেগেছিল। কিন্ত খারাপ লেগেছিল যখন জানতে পারলাম ল্যাবগুলো ভালভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। সেখানকার সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বেশির ভাগই উদ্ভিদ বিজ্ঞান ব্যাক-গ্রাউন্ডের। পিএইচডি পর্যায়ে ওনারা মলিকিউলার কাজ করেছেন, তাও উদ্ভিদ নিয়ে। তবে সেখানকার প্লান্ট ব্রিডিং ডিপার্টমেন্টটি খুব এক্টিভ। সেখানে এইচপিএলসি মেশিন আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় মেশিনটি চালানোর মত কোন গবেষক বা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নেই। অথচ ভার্সিটিতে অর্নাস চতুর্থ বর্ষে আমরা এইচপিএলসি মেশিন চালাতে শিখেছি। বাংলাদেশে এসব গবেষণা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলতে বায়োটেকনোলজিস্টের নিয়োগ আমাদের প্রাণের দেশটাকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
গত বছর প্রায় সকল দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সিকুয়েন্সিং মেশিন ক্রয় বাবদ উপর ওলাদের দুর্নীতির কথা জাতির সামনে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর জন্য মেশিনগুলো কেনা হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, সিকুয়েন্সিং মেশিন চালানোর মত দক্ষ জনবল আমাদের দেশে খুবই কম, যারা আছেন তারা সবাই মলিকিউলার বায়োলজিস্ট। কিন্তু কোন হাসপাতালে ওনাদের নিয়োগ বা মূল্যায়ন নেই। বিষয়টি হাস্যকর বলব নাকি কস্টের বলব আমার বুঝে আসছে না। নিভৃতে মেশিনগুলো নস্ট হচ্ছে।
শত হতাশার পর আমি আশাবাদী, একদিন এ লাইফ সাইন্স গবেষকদের মূল্যায়ন দেশে হবে, হয়তো সেটা অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তাদের বিষয়টি আমলে নেয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ।
এ কে এম জাকির হোসেন
এম এস
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।