বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
শাবান মাসের ফজিলত ও করণীয়
/ ১৯৮ Time View
Update : শুক্রবার, ১৯ মার্চ, ২০২১, ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

মুহাদ্দিস আজিম উদ্দিন বিন মজনু

হিজরি চন্দ্রবর্ষের অষ্টম মাসের নাম শাবান।মাসটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাসটির নামকরণের প্রতি লক্ষ করলেই এর গুরুত্বের বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। আরবিতে এই মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআজজম’ অর্থ মহান শাবান মাস। শাবান শব্দটির অর্থ শাখা-প্রশাখা, ছড়িয়ে পড়া, দূরে ও কাছে, মিলন ও বিচ্ছেদ এবং সংশোধন বা সুশৃঙ্খলা ও ফ্যাসাদ বা বিশৃঙ্খলা। শাবান মানে দুটি শাখা বা সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈশাদৃশ্যপূর্ণ। বিপরীতধর্মী দুটি বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এ যেন একই অঙ্গে দুটি রূপ। যেমন দুটি শাখা ভিন্ন হলেও একই কাণ্ড মূলে মিলিত; হাতের পঞ্চ আঙুল ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু একই সঙ্গে কাজ করে। অর্থাৎ ভিন্নতায়ও ঐক্য। শাবানের আরেকটি অর্থ হলো মধ্যবর্তী সুস্পষ্ট। যেহেতু এই মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী, তাই এই মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। (লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর রহ.)।
শাবান মাসের আগের মাস রজব মাস অর্থাৎ রজব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে আরবদের ঐ সময়ে ঘরে বসে সময় কাটাতে হতো। আর শাবান মাসের পরের মাস রমজান ছিল প্রচণ্ড গরমের মৌসুম। বিধায় প্রকৃতির রুক্ষতার কারণে রমজান মাসেও তারা ঘর থেকে বের হতে পারত না। মাঝখানের এই মাসটিই ছিল তাদের জন্য জীবিকা উপার্জনের মোক্ষম সময়। তাই তারা এই সময়ে জীবিকার সন্ধানে এই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত।

সুতরাং মাসটির নামকরণ করা হয়েছে শাবান। জীবন ও জীবিকার জন্য আরবদের কাছে শাবান মাসটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ধর্মীয় দিক দিয়ে মুসলিম সমাজের কাছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর অতীব গুরুত্বের কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবানকে নিজের মাস বলে অভিহিত করেছেন। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রজব হলো আল্লাহর মাস। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর মাস রজবকে সম্মান করল, সে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করাবেন। আর শাবান হলো আমার মাস। আর যে ব্যক্তি শাবান মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল সে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আর যে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, কিয়ামতের দিন আমি হব তার অগ্রবর্তী এবং নেকির ভাণ্ডর। আর রমজান মাস হলো আমার উম্মতের মাস। (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৫৩২)

শাবান মাসের কিছু বিশেষত্বও রয়েছে। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই মাসেই কিবলা পরিবর্তন হয়; অর্থাৎ পূর্ব কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কাবা কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয় । আল্লাহ তায়ালা বলেন, বারবার আপনার আকাশের দিকে মুখমণ্ডল আবর্তন আমি অবশ্যই লক্ষ করি। সুতরাং কিবলার দিকে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করে দেব, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। অতএব আপনি মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ঘোরান। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন ওই (কাবা) দিকেই মুখ ফেরাও।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৪৪)। তাই শাবান মাস একদিকে ইসলামি ঐক্যের মাস, অন্যদিকে কাবাকেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হওয়ার মাস।

প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশনাসংবলিত অসাধারণ আয়াতটি এই মাসেই অবতীর্ণ হয়। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা রাসূল (সা.)-এর প্রতি পরিপূর্ণ রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ নবীজির (সা.) জন্য রহমত কামনা করেন; হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং যথাযথভাবে সালাম পেশ করো।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৫৬)।

সুতরাং শাবান মাস হলো নবীজির প্রতি অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রেম-ভালোবাসা প্রদর্শনের মাস। তা হতে হবে সুন্নত অনুশীলনের মাধ্যমে। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, ‘হে বৎস! যদি পারো এভাবে সকাল ও সন্ধ্যা পার করো যেন তোমার অন্তরে কারও প্রতি হিংসা না থাকে, তবে তাই করো।’ অতঃপর বললেন, ‘এটাই আমার সুন্নত আদর্শ, যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অনুসরণ করল, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকে ভালোবাসল; যে আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ ” (মিশকাতুল মাসাবিহ, তিরমিজি শরিফ: ৩৬: ১৭৫)।

পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে শাবান মাসের ফজিলত অনেক বেশি এবং সে উদ্দেশ্যে শাবান মাসে মুমিন মুসলমানের জন্য বেশ কিছু করণীয় রয়েছে।মাহে রমজানে নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতকে গতিশীল করতে শাবান মাসে যে সমস্ত করণীয় রয়েছে সেগুলো হলো :-
(১) দিন গণনা :
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজানের (প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে) শাবানের দিনগুলো গণনা করতে থাকো। (মুসান্নেফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৩০৩, সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ৬৭৮, আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৮২৪২)।

 (২) বেশি বেশি করে নফল রোজা রাখা :
রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি নফল রোজা রাখতেন। হজরত আয়েশা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি এবং আমি তাঁকে শাবান মাসের মতো এত অধিক নফল রোজা অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি। (সহিহ আল-বোখারি, হাদিস : ১৯৬৯, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৫৬, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৩৪, সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ৭৩৬)।

(৩)নফল ইবাদত বেশী করা

নামাজ, রোজা, জিকির, তিলাওয়াতসহ বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যেন মাহে রমজানের আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয় এবং গতিশীলতা হারিয়ে না যায়।

 (৪) স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ করে লক্ষ রাখা। যেন সুস্থ থেকে স্বাভাবিকভাবে গোটা মাহে রমজানের যাবতীয় আমল পালন করা যায়।

(৫) শাবান মাসের ১৫ তারিখের পরে আর বেশি নফল রোজা না রাখা। হজরত কাতাদাহ (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজান মাস ও শাবান মাসের মাঝে এক বা দুই দিনের ব্যবধান বজায় রাখো (রোজা রাখা বর্জন করে)। ( মুসান্নেফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৩১৬)।

(৬) নফল সাদাকাহ করা :
শাবান মাসে বেশি বেশি দান-খায়রাত করা। যাতে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মুসলমানরা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে মাহে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে।

(৭) বেশি বেশি দোয়া করা : মহান আল্লাহর দরবারে রমজান মাসপ্রাপ্তির জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রজব মাস আরম্ভ হলেই রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন, হে আল্লাহ। আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করো এবং রমজান মাস পর্যন্ত আমাদের পোঁছে দাও। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৪৭, মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস : ৬৪৯৬, আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৩৯৩৯)

অতএব, পরম করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ দয়া ও ক্ষমার দৃষ্টি লাভের আশীয় শাবান মাসব্যাপী অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি ও তওবা- ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

মুহাদ্দিস আজিম উদ্দিন বিন মজনু
ইমাম এন্ড খতিব;হ্যাটফিল্ড জামে মাসজিদ,আমেরিকা।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
আমাদের ফেইসবুক পেইজ