বি.ইউ রাসলে
বায়ান্ন থেকে কুড়ি : কি পেয়েছে জাতি কিছুদূর এগোতেই দেখা গেল এক মেয়ে তার বাবার সাথে ফুল দিতে যাচ্ছে। তার পরণে কালো সালোয়ার। ডিজাইনে শহীদ মিনারের ছবি। চমৎকার লাগছিল সোনামণিটাকে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখানে কেন এসেছ? সে বলল, ফুল দিতে। ঠিক তার কাছে কয়েকজন উঠতি বয়সের তরূণ দেখা গেল। তারা আমার কথা শুনে হাসছিল। আমি কি মনে করে তাদের জিজ্ঞেস করলাম,’ আচ্ছা , আজকের এই দিনে কি হয়েছিল বলতে পারবে?’ একজন ফিক করে হেসে বলল,’ ওমা, আপনি জানেন না কি হয়েছিল?’ আমি বললাম, ‘না, জানি না, কি হয়েছিল বলতো’ সে বলল, ‘এই দিনে অনেক মানুষ মারা গেসিল, ভাষার জন্যে।’ আমি বলি, ‘কারা মারা গিয়েছিল?’ সে বলে, ‘এই ত গেসিল, নাম মনে নাই এখন, ভুইলা গেসি’।
আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু ভাষার জন্যে কেন মারা গেল, ওরা আসলে কি করেছিল?’ সে বলে,’ পুলিশ গুল্লি করসিল, এইজন্যেই তো মরসে, আর কেমনে মরব বলেন’। আমি বললাম, তুমি কিসে পড়, সে বলল, ইন্টার ফাস্ট ইয়ার। আমি আর কিছু বলি না, চলে আসি সেখান থেকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ অব্দি উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া একটি ছেলের আমাদের ভাষা আন্দোলনের কথা জানাতে পারেনি। ভাষা শহীদদের নাম জানাতে পারেনি। এ লজ্জা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নয়, এ লজ্জা আমাদের সবার। শাহবাগ থেকে ধানমণ্ডি আসলাম। উদ্দেশ্য রবীন্দ্র সরোবর। হেঁটে হেঁটে আসলাম পুরো রাস্তা। এখানেও উৎসবের আমেজ। কড়া মেক আপ, বুটিক হাউস থেকে কেনা অ আ লেখা শাড়ি বা পাঞ্জাবি। আবারো প্রেমিক যুগলের ছড়াছড়ি দেখা গেল। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে চমৎকার অনুষ্ঠান হয়ে গেল। ফেরার পথে, রাস্তার ওপাশে একটা রেস্টুরেন্টে জোরে হিন্দি গান বাজাতে শুনলাম।
ম্যানেজার কে বলতে যাব, তখন দেখি ম্যানেজারের জায়গায় এক মুশকো লোক, চোখে সানগ্লাস, হাতে সিগারেট নিয়ে ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়ছে। তাকে বললাম, ভাই, হিন্দি গান বন্ধ করেন। সে খেকিয়ে বলল, কেলা, বন করমু কেলা? তার কথা শুনে বুঝলাম, আসলেই তো সে কেন বন্ধ করবে ? বাংলা তো তার ভাষাই না! বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশের নাম ভাষার নামের সাথে যুক্ত। বাংলা ভাষাই সর্বপ্রথম আমাদের আন্দোলন করে নিজেদের অধিকার আদায় করতে শেখায়। যার পথপরিক্রমায়, একাত্তরে স্বাধীন দেশের সূচনা হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত পাঁচ ভাষা শহীদ রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর ও সালাম-এর নাম আমাদের জানা। শুধু বাংলা ভাষা নয়, যে স্বপ্ন সাধনে বাঙালিরা আত্মত্যাগ করেছিল, সে দায় থেকে বাঙালি জাতি কতটুকু মুক্তিলাভ করেছে, শতবর্ষের পাদদেশে পৌঁছে আজও আমরা গণিতের সে হিসাব নিরূপন করতে পারিনি।
অন্যদিকে যে স্বপ্ন সাধনে বুকের তাজারক্ত দিয়ে রাজপথ রঙ্গীন করেছিল, তাদের মূল্যায়নই-বা আমরা কতটুকু করেছি বা করছি আজ তাও বিবেচ্য বিষয়। বাংলা ভাষা আজ প্রতিষ্ঠিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু সাধারণ মানুষের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বঞ্চিতের কান্না থামেনি। আদর্শ পদদলিত, চলছে শক্তি দিয়ে শাসন। জাতির দুর্ভাগ্য, গলার যে কাঁটা ছাড়াতে এত রক্ত বিসর্জন, সে কাঁটা আজও গলায় বিধে আছে!
আমাদের দেশে রাজনৈতিক অঙ্গণে বহু পালাবদল হয়েছে কিন্তু ভাষা শহীদ পর্বের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। রাজনৈতিক পালাবদলের ধারাবাহিকতায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে পাঠাগার ও স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর অংশ হিসেবে মানিকগঞ্জের শহীদ রফিক উদ্দিন, ময়মনসিংহের আব্দুল জব্বার এবং ফেনীর আব্দুস সালাম স্মরণে খুব অল্প সময়ে তিনটি পাঠাগার ও স্মৃতি যাদুঘরের সুদৃশ্য ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। নিজস্ব জমির অভাবে স্থগিত রয়ে যায় শহিদ আবুল বরকত ও শহিদ শফিউর রহমান স্মৃতি ভবনের নির্মাণ কাজ। এর পর বিভিন্ন সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পলাশীর মোড়ে শহিদ আবুল বরকত স্মৃতি ভবনের নির্মাণ কাজ হাতে নেন।
কিন্তু সময়ের অভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ভবনের কাজ শেষ করে যেতে পারেনি। নির্মাণাধীন ভবনের অবশিষ্ট কাজ পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের সময় শেষ হয়। এটা ভাষা শহীদের ৪র্থ স্মৃতি ভবন। তবে দুঃখের কথা হলো, শহীদ শফিউর রহমানের স্মৃতি ভবনটি নির্মাণের আজও কোন উদ্যোগ নেই। শহীদ শফিউর রহমান স্মৃতি ভবন কবে, কোথায় নির্মাণ করা হবে, তাও অজানা। শহীদ শফিউর রহমানের বিধবা স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র শফিকুর রহমান উত্তরায় বসবাস করছেন। সুতরাং ঢাকা বা উত্তরার যেকোনো জায়গায় সরকারের পতিত সম্পত্তিতে শহীদ শফিউর রহামের স্মৃতি ভবন নির্মাণের জোর দাবি ভাষা প্রেমিদের।
আমরা বাংলা ভাষা ও ভাষা শহীদদের নিয়ে হৃদয়ের নিংড়ানো দরদের অনেক কথা বলে থাকি। মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে পরিচিত, বিরল সম্মানে ভূষিত একটি দেশ। কিন্তু যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময় বিরল সম্মান অর্জিত হলো তাদেরকে নিয়ে দেশে আজও টাল-বাহানা চলছে। ‘৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারী রাজপথে রক্তদিয়ে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ও পর্ব শেষ। তবে এখন উহার বাস্তব প্রয়োগ দরকার। যারা সরকারে আছেন তাদের মর্জি। সরকার চাইলে আমাদের দেশের অভ্যান্তরে সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন সম্ভব। তাছাড়া মাতৃভাষার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত না হলে মর্যাদা ফিরে আসবে না, ভাষা প্রেমিদেরও কদর বাড়বে না এবং সাহিত্যে বিকাশও ঘটবে না।
সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের অনিহার কারনে ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে না, বরং হ্রাস পাচ্ছে। বাংলা ভাষার প্রতি অনাদর-অবহেলার কারনে নুতন প্রজন্মের সন্তানেরা সংলাপের মধ্যে কথায়-কথায় ইংরেজী অনুকরণ বাট-সো বলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। ধীরে ধীরে এ অবস্থার প্রসার হলে ভাষার মান বিনষ্ট হবে, কদর আরও কমে যাবে। মহান একুশের দিনগুলিতে ঢাকা কেন্দ্রীক কিছু কিছু লোকদের সম্মানিত করার খবর প্রকাশ হয়। খবর শুনে মনে হয় যেন, ৫২’র একুশ শুধু ঢাকাতেই ঘটেছিল। আসলে বাস্তবতা ভিন্ন। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় দেশের সর্বত্র ও সর্বস্তরে মানুষের অবদান ছিল সন্দেহ নেই। তাদেরকেও আমাদের খুঁজতে হবে।
আমরা কি আজো পেরেছি বাংলাভাষার উপর উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে? বাংলা একাডেমি জনগণের জন্য তৈরী করলেও অর্ধশত বছর পরে এসে আজ তা কেবলই ডান আর বামের আধিপত্ত্য যুদ্ধে সীমাবদ্ধ। আমাদের ভাষার আন্তর্জাতিক মানউন্নয়নে নেই কোনো মানসম্মত সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে বাংলা বিভাগ থাকলেও নেই উন্নয়নমুলক কোনো গবেষণা প্রতিবেদন। আলীয়া বা সরকারী ধারার মাদ্রাসাগুলো কিছুটা বাংলা ব্যকরণ চর্চা হলেও ক্বওমী ধারা বা ভারতের দেওবন্দ আদর্শের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সে চর্চা একেবারেই নেই কতিপয় হাতেগনা দু’একটা প্রতিষ্ঠান ছাড়া। বিতারিত উর্দুভাষার বিকাশে যত গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় বাংলা ভাষা সে জায়গার কাছেও নাই। যার ফলে দেখা যায় বেশীর ভাগ ওয়াজেন ও ইমামদের বক্তব্যে ভূলে ভড়া উচ্চারণ।
বিশ্বব্যাপী আরবী ও ইংরেজিসহ আরো কিছু ভাষার যে শক্তিশালী ব্যাকরণ গ্রামার রয়েছে এবং সেগুলোর উপর যুগের পর যুগ যে গবেষণা চলছে সে-তুলনায় রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পরিচিত বাংলা ভাষা বিশ্বের তলানিতেই পরে রয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা যায় সরকারীভাবে এখনো আমরা ভাষা কে সেই গুরুত্ব দেইনি কতিপয় কিছু দিবস ছাড়া। এখনো সরকারী দাপ্তরিক কাজে বাংলার শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করি নাই। দেশীয় রাষ্ট্রীয় কাজে বিদেশীদের জন্য বাংলা বাধ্যতামুলক না করে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা তাদের সুবিধার জন্য ট্রান্সলেটর নিয়োগ করি, এগুলো আমাদের ভাষার মর্যাদাকেই কেবল নিচু করে।
কোনো দুতাবাসে আমরা বিদেশি বাংলা এক্সপার্টকে নিয়োগ করতে বাধ্য করি নাই, বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, অর্থবিভাগ সবখানে এখনো ইংরেজিতেই সব কিছু করা হয়। নেমপ্লেট থেকে দোকান মার্কেট বাসাবাড়ি সবখানে বাংলা ভাষায় লেখা এবং তা প্রথম লাইনে রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামুলক করি নাই। ভাষা দিয়ে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পাওয়া জাতি হিসেবে কি আমরা অর্জন করলাম, শতবর্ষের পাদদেশে এসে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষের সমগ্র জাতি ও বাংলা ভাষার জন্য কি অর্জন করতে পারলাম? বায়ান্ন থেকে কুড়ি জাতি হিসেবে কি পেয়েছি?