ছোট বেলায় মা যখন কোন শুকনো খাবার (মুড়ি,বিস্কিট) খেতে দিতেন তখন কখনোই দুই হাত ভরে কিছু খেতে দিতেন না।একটু বেশি দিতে হলেও প্রয়োজনে আলাদা কোন পাত্রে দিতেন।সবসময় একটা হাত খালি রেখে দিতেন আমাদের।
এক্ষেত্রে মায়ের সরল একটা যুক্তি রয়েছে-
দুই হাত ভরে পাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলে কখনো যদি দুই হাত ভরে দিতে না পাড়েন তখন তো কান্নাকাটি হল্লা হাটি শুরু করবো।
অর্থাৎ জীবনে সবসময় দুই হাত ভরেই কিছু পাবো ব্যাপার টা এমন নয় কখনো কখনো এক হাত খালি রেখেও ফিরতে হবে।(এখানে মুড়ি, বিস্কিট একটা প্রতিকি মাত্র)
প্রায় দশ বছর আগের কথা।কোন এক জরুরি কাজে একটু বাজারে যাবো কিন্তু সাইকেলের চাবি খুঁজে পাচ্ছি না।চাবি থাকার সম্ভাব্য সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজা শেষ। মা বাইরে কাজে ব্যস্ত। তারপরও মাকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলাম।
– মা, মা, ও- মা…..সাইকেলের চাবি কোথায়??
– তুই কই রাখস তুই জানস না??
– এখানেই তো ছিলো খুঁজে পাচ্ছি না তো।
-আল্লাহ চোউখ দিছে ক্যান,ভালো কইরা চোউখ মেইল্যা দেখ।
– সকালেই তো এখানে রাখলাম, পাইতেছিনা তো এখন!
– মা..মা..ও- মা….
মা কাজ রেখে ঘরে আসলেন,।মা কি করলেন আমি জানি না, পনেরো মিনিট ধরে খুঁজে না পাওয়া চাবিটা মাত্র তিন মিনিটেই মা’র হাতে।
চাবি আমার হাতে দিতে দিতে মা বললেন..
-নিজের জিনিস কই রাখস নিজেই জানস না,আর কাজের সময় শুধু মা মা….
আমি অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে থাকিয়ে ভাবলাম ” মা কি কোন ম্যাজিক জানে” !
সম্ভবত তখন আমি ক্লাস থ্রী অথবা ফোর’এ পড়ি।প্রচন্ড জ্বর। জগতসংসার বিস্বাদ। রাজ্যের ওষুধ, ডাক্তার, আত্নীয় স্বজন, নানান ট্রিটমেন্ট।
দুইদিন রাণীক্ষেত রোগে আক্রান্ত মুরগির মত ঝিমানো ছাড়া মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল না শরীরে।
মাঝরাতে হঠাৎ পানির তৃষ্ণা, বুকের ভেতর তীব্র হাহাকার,
– মা, মাগো, ও মা, মা…
নাকের ভেতর হঠাৎ মায়ের আঁচলের ঘ্রাণের উপস্থিতি , ‘ও মা, মাগো… মা, ও-মা, মায়ের আঁচল। আঁচলের ঘ্রাণ’।
কপালের ওপর তখন মায়ের প্রসারিত হাতের স্পর্শের চেষ্টা । জ্বর তীব্র জ্বর, কপালে ডিম ভাজার উপক্রম।মায়ের স্পর্শ আর আঁচলের ঘ্রানে জ্বরের তাপমাত্রাটা মিটারের কাটার মত উল্টো ঘুরে শূন্যের কাছাকাছি চলে এলো। মায়েরা জাদু জানেন, একটু আঁচলের ঘ্রাণ, একটু কপালে স্পর্শ! সেই স্পর্শের ক্ষমতা দেখে হয়তো ওষুধ পথ্যরাও হতভম্ব হয়ে যায়। হয়তো তারাও ভাবে, ‘নিশ্চয়ই তিনি ম্যাজিক জানেন?’
এখন বড় হয়েছি। জেনেছি ম্যাজিক বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। যা আছে তা হলো কৌশল, ট্রিকস, চোখে দুলো দেয়া।
তাহলে মা কি আমাদের চোখে দুলো দিতেন?
হা দিতেন।সন্তানের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য চোখে দুলো দিতে হয় মায়েদের।
মায়েদের এই কৌশল গুলো জানতে হয়।জানতে হয় কিভাবে চোখের পলকে সব কিছু খুঁজে পেতে হয়।জানতে হয় তার সন্তানকে কখন কোন শিক্ষাটা কিভাবে দিতে হবে।মায়েদের জানতে হয় কিভাবে একটা ডিমের সাথে কুমড়োর ফুল বেটে দুইটা ডিম ভাজি করা যায়।এমন অজস্র ট্রিকস মায়েদের জানতে হয়।
এখন মাঝে মাঝেই ভেবে অভাক হয়- দর্শনশাস্ত্র না পড়েও আমার মায়ের কি জীবনাদর্শন!
হয়ত মায়ের এই ছোট ছোট শিক্ষা থেকেই এখন প্রাপ্তিতে দুই হাত পূর্ণ না হলেও আর মন খারাপ হয় না।ঠোঁটের খোনায় হাসি রেখে অপূর্নতা কে পূর্নতায় রুপ দিতে পারি।
মাদার ইজ ওয়ান অ্যান্ড অনলি ম্যাজিশিয়ানস অন আর্থ!
জুয়েল মাহমুদ
মালয়েশিয়া প্রবাসী
১৯/১২/২০২০