পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই বিজয়ের কোনো না কোনো দিন রয়েছে। তারা সেদিন তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী বিজয় উদযাপন করে থাকে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাঝে যেমন রয়েছে এক মর্মান্তিক ঘটনা, ঠিক তেমনি রয়েছে গৌরবজনক ইতিহাস। এই মহান বিজয়ের জন্য আমরা ১৯৭১ সালে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করেছি। এরপর এক সাগর রক্ত,পাহাড় সমান লাশ, হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ এবং মা-বোনদের ইজ্জত আর লক্ষ লক্ষ টাকার দেশীয় সম্পদের বিনিময়ে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি।পেয়েছি বাংলাদেশ নামের আলাদা সীমানা ও মানচিত্র। পেয়েছি স্বতন্ত্র এক সংবিধান এবং লাল-সবুজের পতাকা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৯০ হাজার সদস্য বাংলাদেশ এবং ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে।
তাহলে বুঝা গেল, আমাদের এই স্বাধীনতা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এই স্বাধীনতাকে কণ্টকমুক্ত করতে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের এ ভূমিকা ছিল ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মভূমির প্রতি তার বাসিন্দাদের পবিত্র দায়িত্ব। কারণ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী স্বাধীনতা আল্লাহ্ তা’য়ালার পক্ষ থেকে এক বড় নেয়ামত। ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, শাশ্বত সত্য বলে ইসলামে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘দেশ রক্ষার্থে একদিন এক রাতের প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারা রাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়ার চেয়ে উত্তম।’ (সহীহ মুসলিম)
রসুলুল্লাহ (সা:) নিজে স্বদেশকে ভালোবেসে আমাদের জন্য দেশপ্রেমের অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন। রসুলুল্লাহ (সা:) তাঁর স্বদেশ মক্কাকে ভালোবাসতেন, মক্কার জনগণকে ভালোবাসতেন। তাদের আল্লাহর পথে আনার জন্য তিনি অপরিসীম অত্যাচার সহ্য করেছেন। তার পরও কখনো স্বদেশবাসীর অকল্যাণ কামনা করেননি। তায়েফে নির্যাতিত হওয়ার পরও কোনো বদদোয়া করেননি।
তাই মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো, তার মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। এটাই রাসুলুল্লাহ (সা:) আদর্শ। আল্লাহর রাসুল (সা:) যখন মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিবের (মদিনার পূর্বনাম) দিকে পাড়ি জমাচ্ছিলেন, তখন তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু বয়ে যাচ্ছিল। তিনি মনে মনে বলেছিলেন, হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনো আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না। [ইবনে কাসির ৩/৪০৪]
তাফসিরে কুরতুবিতে এসেছে, যখন রসুলুল্লাহ (সা:) নিজের জন্মভূমি মক্কা নগরী ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। দেশের জন্য, জন্মভূমির জন্য রসুলুল্লাহ (সা:) এর মায়া ও ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। পরবর্তীতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় হাবিবের মাধ্যমে মক্কাকে মুশরিকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে, স্বাধীনতা দিয়ে ধন্য করেছেন।
রসুলুল্লাহ (সা:) মদিনাকেও অনেক ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে উহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজীর চেহারাতে আনন্দের আভা ফুটে উঠত এবং তিনি বলতেন, এই উহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও উহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। (বুখারি, মুসলিম)
এখন আসুন,বিজয় দিবস উদযাপন উসম্পর্কে ইসলাম কী বলে? এদিন আমাদের কী করা উচিত?মানবজীবনে এমন কোনো বিষয় নেই, যার বর্ণনা কুরআন-সুন্নাহ্ বা ইসলামে নেই। বিজয় দিবসের করনীয় সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনের দুটি সূরা আলোচনা করেছেন।একটি সূরা আল-ফাতাহ (বিজয়), আরেকটি সূরা আন-নাসর (মুক্তি ও সাহায্য)। সূরা নাসর-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।’
এ সূরায় বিজয় দিবসে মুসলমানদের পালনীয় তিনটি কর্মসূচির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
১।এই দিনে আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করা।
২। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।
৩। যুদ্ধ (জিহাদ) চলাকালীন সময় যদি ভুলত্রুটি হয়ে থাকে,সেজন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
বিজয় দিবসে আমাদেরও এই তিনটিই জাতীয় কর্মসূচি হওয়া উচিত।আল্লাহ তায়ালার এই তিনটি নির্দেশনার মধ্যে অনেক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে আমরা পাক হানাদার বাহিনিকে পরাজিত করেছি। এ সময়ে অনেক জান-মালের ক্ষতি হয়েছে।অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজয় ও স্বাধীন মাতৃভূমি দান করেছেন। যে দেশে আমরা বাংলা ভাষায় সবকিছু করতে পারছি। আমাদের কথা বলার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার ফিরে পায়েছি।
বিজয় অর্জন করা আর স্বাধীন হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ কী হতে পারে? এ কারণেই আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, তোমরা বিজয় লাভ করেছ, এখন তোমাদের কাজ হচ্ছে, এ বিজয়ের জন্য আল্লাহর কাছে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে কিংবা তাসবিহ পাঠ করে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রক্তারক্তি হয়েছে, ভুলত্রুটি হয়েছে, অন্যের অধিকার নষ্ট হয়েছে, এর জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাওয়া।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আমরা আট রাকাত নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এ দিনটিকে উদযাপন করতে পারি:
আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযি (রহ:) তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদে’ উল্লেখ করেন, আল্লাহর রাসূল (সা:) একটি উষ্ট্রীর উপর আরোহিত ছিলেন, তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সঙ্গে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন)। প্রথমে তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় বিজয়ের নামাজ। এরপর তিনি হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! তের বছর ধরে আমার উপর, আমার পরিবারের উপর, আমার সাহাবীদের উপর নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালিয়েছ, এর প্রতিবদলায় আজ তোমাদের কি মনে হয়, তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব?
তারা বলল: হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের প্রতি উদার, আমাদের প্রতি উদারতা ও মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
আল্লাহর রাসূল (সা:) বললেন, হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সবার জন্য ইউসুফ (আ:) এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না। [সুনানে বাইহাকি ৯/১১৮]
রাসুলুল্লাহ (সা:) তাঁর কথা অনুযায়ী কারো ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি, কোনো অপরাধীর বিচার করেননি, বরং সবাইকে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ইচ্ছা করলে তিনি অপরাধীদের সঙ্গে যা খুশি তাই করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবাইকে ক্ষমা করে মুক্ত-স্বাধীন করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, যাবতীয় ক্ষমতার মালিক কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী) আপনি বলুন, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান করেন, আবার যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা কেড়েও নেন, যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন, আবার যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন; সবরকমের কল্যাণ তো আপনার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান।’ {সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত ২৬]
রাসুলুল্লাহ (সা:) মক্কা বিজয়ের দিন আরো একটি কাজ করেছিলেন, তিনি কাবাঘরের মূর্তিগুলোকে ভেংগে দিয়ে আল্লাহর ঘরকে পবিত্র ঘোষণা করেছিলেন। তাই বিজয়ের এই দিনে মুসলমানদের উচিত, নিজেদে মন-মগজ থেকে আল্লাহ, রাসূল এবং ইসলাম বিরোধী আক্বীদাকে ফেলে দিয়ে, নাস্তিক্যবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাওহিদ এবং আল্লাহর একত্মবাদকে প্রতিষ্ঠা করা।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে আমরাও আট রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে পারি। এদিন আরো যে কাজগুলো করা উচিত তা হলো, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শহীদ/গাজীদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা সভার আয়োজন করা। তাদের জন্য দোয়ার আয়োজন করা। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পঙ্গুত্ব বরণকারী এবং অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা যারা মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন তাদের গুনাহ মাফ করে যেন জান্নাতবাসী করেন, শত্রুরাষ্ট্রের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেন, এদেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি দান করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা চিরদিন অক্ষুন্ন রাখেন।
অপরদিকে বিজয় দিবসে বেগানা নারী-পুরুষ একসঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা, নাচ-গান করা, আতশবাজি ফুটিয়ে লাখ লাখ টাকা অপব্যয় করা ইসলাম সমর্থন করে না। এগুলোর দ্বারা দেশেরও কোনো উপকার হয় না এবং শহীদদেরও কোন উপকার হয় না।
তাই, বাংলাদেশের প্রত্যেক মুসলমানের উচিত ইসলামের আলোকে বিজয় দিবস উদযাপন করা।সকল ধর্মের মানুষ মিলেমিশে অবস্থান করা এবং লাল-সবুজের এই দেশকে আরো বেশি স্বনির্ভর করে তুলে এদেশের বিজয় ও স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করা।
মুহাদ্দিস আজিম উদ্দিন বিন মজনু
ইমাম এন্ড খতিব, হ্যাটফিল্ড জামে মাসজিদ, আমেরিকা।