মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
ফ্রি ফায়ার-পাবজি গেমে আসক্ত তরুণ সমাজের প্রতিকারের উপায়
/ ৩০৮ Time View
Update : রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:৫৫ অপরাহ্ণ

রেস্তোরাঁর টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে, সেদিকে মন নেই কারও, যে যার মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত। অবস্থা যদি এমন হয় তবে গেম আসক্তির আশঙ্কা থেকে যায়।

গেমিং অ্যাডিকশন—অনলাইন, মোবাইল বা ভিডিও গেমে আসক্তিকে মনঃস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাদকাসক্তির মতো ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত থাকা বা গেম খেলাও আসক্তি। এটা আচরণগত আসক্তি। কেবল সচেতনতাই পারে এই আসক্তি থেকে মুক্ত করতে। লিখেছেন মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল।

১৩ বছরের আহনাফ। ক্লাস সেভেনে পড়ে। পড়ালেখায় ভালোই ছিল। একদিন তার মামা তাকে একটি স্মার্টফোন উপহার দিল। এরপর থেকে শুরু হলো তার গেম খেলা। বেশির ভাগই অনলাইন গেম। ধীরে ধীরে গেম খেলার পরিসর বাড়তে থাকল। অনলাইনে দেশি–বিদেশি নানা গেমারের (গেম খেলোয়াড়) সঙ্গে পরিচয়—ইয়ারফোনে কথা বলা শুরু হলো। ফলাফল, ক্লাস এইটে ওঠার সময় চার বিষয়ে ফেল!

সারা দিন গেম নিয়ে ব্যস্ত, মা–বাবার সঙ্গে কোনো দাওয়াতে যেতে চায় না, বন্ধুদের সঙ্গে মেশে না, গল্পের বই পড়ে না। ক্রিকেট বা অন্য কোনো খেলাও খেলে না। ডিজিটাল পর্দার গেম ছাড়া তার আর কোনো কিছুতে আগ্রহ নেই। বাসায় কয়েক মুহূর্তের জন্য ওয়াই–ফাই বন্ধ থাকলে তার উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। অস্থিরতা শুরু করে। মা–বাবা রাগ করে তার মুঠোফোনটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই শান্ত–সুবোধ আহনাফ অগ্নিমূর্তি হয়ে ধুমধাম করে বাসার দরজা আটকে দেয়, মা-বাবাকে কটুবাক্য বলে, চিৎকার করে আবার তার মুঠোফোনটি নিজের কবজায় নিয়ে আসে। সারা দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে, ইদানীং স্কুলেও যেতে চায় না।

আহনাফের মতো এমন বৈশিষ্ট্যের কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে মা-বাবারা সংকটে থাকেন।

বাংলাদেশেই শুধু নয়, সারা পৃথিবীতেই এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন জরিপ আর গবেষণার পর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১), ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ হিসেবে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য আইসিডি-১১ শীর্ষক রোগ নির্ণয়ে গাইডবুকে এটি সংযুক্ত করা হযেছে।

অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত মানসিক রোগ নির্ণয়–বিষয়ক গাইডলাইনে (ডিএসএম-৫-) বিষয়টিকে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করে গবেষণার ভিত্তিতে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করার সুপারিশ করেছিল।

এটা আচরণগত আসক্তি: যদিও গেম আসক্তি বিষয়টি ইন্টারনেট আসক্তি থেকে খানিকটা আলাদা। কখনো দেখা যায় ইন্টারনেটে কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে গেম খেলছে, কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, কেউবা নানা সফটওয়্যার বা এসব নিয়ে মশগুল আর কেউবা ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে দিনের বেশির ভাগ সময়। মোটদাগে সবই হচ্ছে ননকেমিক্যাল অ্যাডিকশন বা আচরণজনিত আসক্তি। বিশ্বজুড়ে এই বিষয়ে প্রকাশিত ১৬টি গবেষণাপত্রের মেটা অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছে। যাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী (জে ওয়াই ফ্যাম, ২০১৮)।

বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসির তথ্যমতে, এপ্রিল ২০১৯–এ বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক, আর এদের মধ্যে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরী। এরাই কিন্তু গেমিং আসক্তি হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

নিষিদ্ধ বিষয় নয়, তবে ক্ষতিকর: ইন্টারনেট বা গেম খেলা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়। কিন্তু এর ক্ষতিকর, অযৌক্তিক, অপরিমিত ব্যবহার চিন্তা আর আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। এই ইন্টারনেটের ব্যবহার বা গেম খেলার বিষয়টি যখন তার চিন্তা আর আচরণের ওপর খারাপ ধরনের প্রভাব ফেলবে, সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দেবে বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান খারাপ করে দেবে তখন তা আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়।

যেভাবে বাড়ে আসক্তির প্রবণতা: সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোনসহ নানা যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দেন ব্যস্ত মা–বাবারা। তাঁরা নিজেরাও মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকেন। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সন্তানকে সব সময় নিজের চোখের সামনে দেখতে চান মা-বাবা। সে ক্ষেত্রে তাদের হাতে মুঠোফোন-ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তি অনুভব করেন, যা শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেটে আসক্ত করে ফেলে। বাবা-মা নিজেরাও যদি সারা দিন ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মগ্ন থাকেন তাহলেও সন্তানের মধ্যে আসক্তির প্রবণতা বেড়ে যায়।

কখন আসক্তি বলব: ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই সেটাকে নেতিবাচকভাবে নেওয়া যাবে না। দেখতে হবে সেটি আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে কিনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য গবেষণা দলের মতে, গেমিং আসক্তির লক্ষণগুলো ১২ মাস ধরে থাকতে হবে। তবে লক্ষণ যদি গুরুতর ধরনের হয় তবে সেগুলো অল্প দিন ধরে লক্ষণ দেখা দিলে সেটাকেও গেমিং ডিজঅর্ডার বলা যাবে।

কিছু লক্ষণ, ইন্টারনেট ব্যবহার বা গেম খেলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অর্থাৎ ঘন ঘন খেলতে থাকবে, অনেক বেশি সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে এবং এত নিবিষ্টভাবে সেটিতে মগ্ন থাকবে যে চারপাশের অনেক কিছু তার মনোযোগ পাবে না।

• দিনের শুরুই হবে ইন্টারনেট ব্যবহার বা গেম খেলার আকুতি দিয়ে, তীব্র আকাক্ষ্মা থাকবে গেম বা ইন্টারনেটের প্রতি। নতুন কিছুর চেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকেই জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করবে।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
আমাদের ফেইসবুক পেইজ