মুহাদ্দিস আজিম উদ্দিন বিন মজনু
ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। সাম্প্রতিক কালে বহুল আলোচিত হয়ে উঠেছে ধর্ষণ শব্দটি। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে ধর্ষণের নানা ঘটনার খবর। গ্রামে কিংবা শহরে, বাড়িতে কিংবা রাস্তায়, অফিসে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনকি চলমান বাসে পর্যন্ত, একথায় বলা চলে প্রায় সর্বত্রই ঘটছে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার। এটি কারো একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব না প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ইসলামসহ কোন ধর্মেই ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক কাজকে উৎসাহিত করা হয়েনি।
ব্যাভিচারের চেয়েও ভয়ংকর অপরাধ হলো ধর্ষণ। ইসলামে ব্যভিচারের মতো ধর্ষণও কবিরা গোনাহের শামিল। সে কারণে যে কোনো ব্যক্তির ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা আবশ্যক।
ধর্ষণ থেকে বাঁচতে যদি ধর্ষণকারীকে হত্যা করার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়, তাতেও সমর্থন দিয়েছে ইসলাম। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
হজরত সাঈদ ইবনে জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহিদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহিদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহিদ।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে আর সে প্রতিরোধে হত্যার মতো কোনো ঘটনা ঘটে তাতেও কোনো দোষ নেই। কেননা সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে যদি প্রতিরোধকারী নিহত হয় তবে সে পাবে শাহাদাতের মর্যাদা। এ প্রতিরোধে সম্ভ্রম লুণ্ঠনকারীও নিহত হতে পারে।
সমাজে ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তিকে বাঁকা চোখে দেখে। তার প্রতি অবহেলা ও নানান কটুক্তি করে থাকে মানুষ। যা কোনোভাবে কাম্য নয়। কেননা ধর্ষনের শিকার হওয়া ব্যক্তি বল প্রয়াগকারী বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির অত্যাচারের শিকার। ইসলামের আলোকে এ ব্যক্তি মাজলুম।
তাই যে ব্যক্তি ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাকে ধর্ষণ হওয়ার কারণে যেমন অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা যাবে না তেমনি তাকে বাঁকা চোখে দেখা কিংবা কটুক্তিও করা যাবে না।
পক্ষান্তরে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগে যদি কোনো ব্যক্তির প্রতি ঘৃণ্য এ অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয় তবে এ কারণে ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তির কোনো পাপও হবে না। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ এবং বল প্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ (ইবনে মাজাহ)
ইসলাম শুধু ব্যভিচারের শাস্তিই ঘোষণা করেনি বরং ব্যভিচারের সমগোত্রীয় ধর্ষণেরও মারাত্মক ভয়াবহ শাস্তির বিধানও রেখেছে। কেননা ব্যভিচার উভয় পক্ষের সম্মতিতে সংঘটিত হয় আর ধর্ষণ এক পক্ষের ইচ্ছায় অন্যের উপর ক্ষমতা বা বল প্রয়োগে হয়।
তাই ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তি মাজলুম বা অত্যাচারিত। আর ইসলামে মাজলুমের কোনো শাস্তি নেই। এক্ষেত্রে শাস্তি হবে শুধু ধর্ষণকারীর। ইসলামে এ সব ক্ষেত্রে শাস্তি প্রয়োগের সুস্পষ্ট বিধান রেখেছে।
ব্যভিচারের শাস্তি
ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। ব্যভিচারী যদি বিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে একশ’ ছড়ি মারা হবে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একই শাস্তি।
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশ’ করে বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর বিধান কার্যকর কারণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। ’ (সূরা নূর: ২)
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশ’ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশ’ বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড)। ’ (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিসের আলোকে অন্য মাজহাবের ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, ব্যভিচারী অবিবাহিত হলে তার শাস্তি দুটো। ১. একশ’ বেত্রাঘাত, ২. এক বছরের জন্য দেশান্তর।
আর হানাফি মাজহাবের বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক্ষেত্রে হদ (শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) হলো- একশ’ বেত্রাঘাত। আর দেশান্তরের বিষয়টি বিচারকের বিবেচনাধীন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে তা প্রয়োগ করতে পারেন।
ধর্ষণের শাস্তি:
ধর্ষণের ক্ষেত্রে একপক্ষে ব্যভিচার সংগঠিত হয়। আর অন্যপক্ষ হয় নির্যাতিত। তাই নির্যাতিতের কোনো শাস্তি নেই। কেবল অত্যাচারি ধর্ষকের শাস্তি হবে। হাদিসে রাসুলে ধর্ষণের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
যেমন- ১. হজরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের (কোরআন-হাদিসে বহু অপরাধের ওপর শাস্তির কথা আছে। এগুলোর মধ্যে যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতি কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত তাকে- হদ বলে) শাস্তি দেন। ’ (ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮)
২. সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম গণিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসির সঙ্গে জবরদস্তি করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হজরত উমর (রা.) ওই গোলামকে কশাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে কশাঘাত করেননি। ’ (সহিহ বোখারি: ৬৯৪৯)
ধর্ষণের ক্ষেত্রে দু’টো বিষয় সংঘঠিত হয়। ১. ব্যভিচার, ২. বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন। প্রথমটির জন্য পূর্বোক্ত ব্যভিচারের শাস্তি পাবে। পরেরটির জন্য ইসলামি আইনজ্ঞদের এক অংশ বলেন, মুহারাবার শাস্তি হবে।
মুহারাবা হলো, পথে কিংবা অন্যত্র অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা। এতে কেবল সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে, আবার কেবল হত্যা করা হতে পারে। আবার দু’টোই হতে পারে। মালেকি মাজহাবের আইনজ্ঞরা মুহারাবার সংজ্ঞায় সম্ভ্রম লুট করার বিষয়টি যোগ করেছেন। তবে সব ইসলামি স্কলারই মুহারাবাকে পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ ও ত্রাস সৃষ্টি ইত্যাদি অর্থে উল্লেখ করেছেন।
মুহারাবার শাস্তি আল্লাহতায়ালা এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো- তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্চনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। ’ (সূরা মায়িদা: ৩৩)
এখানে হত্যা করলে হত্যার শাস্তি, সম্পদ ছিনিয়ে নিলে বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দেওয়া, সম্পদ ছিনিয়ে হত্যা করলে শূলিতে চড়িয়ে হত্যা করার ব্যাখ্যা আইনজ্ঞরা দিয়েছেন। আবার এর চেয়ে লঘু অপরাধ হলে দেশান্তরের শাস্তি দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
মোটকথা, হাঙ্গামা ও ত্রাস সৃষ্টি করে করা অপরাধের শাস্তি ত্রাস ও হাঙ্গামাহীন অপরাধের শাস্তি থেকে গুরুতর।
আল্লাহ আমাদেরকে এই অপরাধ থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করুন, আমিন।
ইমাম এন্ড খতিব; হ্যাটফিল্ড জামে মাসজিদ,আমেরিকা।