“গ্ল্যামার” সখের মোটরসাইকেল। অনেক দিনের সখ একটা মোটরসাইকেল। যখনি উঠতি বয়সি কিরো মুখে “বাইক” শব্দটা শুনতাম তখনি গায়ে আরো জ্বালা ধরত। আহা!….। যাক শেষমেষ অনেক চেষ্ঠা-তদবির করে, জোগার-জন্তর করে একটা বাইক কিনেই ফেললাম। শক যখন বড় বাইক ছোট কিনব কেন? কিনলাম, বড়সড়ই, গ্ল্যামারসস। (যেকোন শব্দের পরে “স” বা “ট” বর্ণযোগে স্মার্ট শোনায়।)
কিন্তু চালাইব কোথায়! বাসা আর অফিস এত কাছে যে মোটরসাইকেল গ্যারেজ থেকে বের করতে যে সময় লাগে তার কম সময়েই অফিস যাওয়া যায়। গিয়ে মোটরসাইকেল গেরেজ করতে করতে অন্যদের উপরে উঠে চা খাওয়া শেষ!
ধ্যাৎ!
চালাবই না।
যাক, একদিন একটু দূরে যাবার সুযোগ হয়েছিল। একি! স্টার্টই নিচ্ছে না। একজন পাশ থেকে ফুরণ কাটল, “তেল নাই”। এ্যাঁ! চৌদ্ধ লিটার তেল ভরে দুই কিলোমিটার চালিয়ে এনে রেখেছিলাম, চৌদ্ধ লিটারে দুই কিলোমিটার! এ জন্যই সবাই মোটর সাইকেল কিনতে না করছিল! তেল খেকো।
একজনকে ফোন দিলাম, “চৌদ্ধ লিটারে দুই দিন যায়, আগে বলবিনা?” তথমত খেয়ে বলল, “স্যার, মেহমান কি বেশী আসছিল?” আমি রাগে আর কথা বলিনি। জিজ্ঞেস করল, “স্যার, তেল নিয়ে আসব?” “নিয়ে আয়” “আপনি যা অতিথিপরায়ন!” “হইছে তেল মারিসনা” “আগে তো নিয়ে আসি”
কলিংবেলের শব্দ। এতক্ষণ লাগে? বলতে বলতে দরজা খুলে দেখি “রূপচাঁদা”র পাঁচ লিটারের কনটেইনার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বলদটা!
“তেল মারছিনা স্যার, সত্যি, ছুটিন দিনে আপনার চেহারাটা আরো সুন্দর হয়েছে, আর লাল পাঞ্জাবিতে আপনাকে যা লাগছেনা স্যার!”
“তেলের বোতলটা খোল্”
“কেন স্যার! আপনার কি হইছে? চোখমুখ এমন লাল হইতেছে কেন?”
বলদরে আর কোন কাজ দেয়া যাবে না। এবার যা করার নিজেই করব।
বাইক ঠেলে ঠেলে গেরেজ থেকে বের করার সময় পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটা বলল, আঙ্কেল বাইক ঠেলতেছেন কেন, দেন আমি বের করে দেই? আমার বাইকটা ক্লাচ প্রবলেম হইছে, গেরেজে নিতেছি।
যাক, ফাজিলডা গেছে।
এইবার ঠেলে ঠেলে দুই কিমি দূরে পেট্রল পাম্পে তেল ভরতে নিয়ে গিয়ে দিলাম তেল ভরতে। ছেলেটা বলে “খুলে দেন”, আমি বললাম “খুলে নেন”। (খুলতে জানিনা বললে প্রেসটিজ সব পড়ে যাবে)। খুলেই আমার চোখের দিকে বড় বড় লাল লাল চোখ বের করে তাকিয়ে আছে। মনে হয় গাঁজা খেয়েছে!
জিজ্ঞেস করলাম “রাতে মনে হয় ভাল ঘুম হয়নি, না?”
“ফাইজলামি করেন?”
“তুমি কি আমার শালা, যে তোমার সাথে ফাইজলামি করব?, আমার একমাত্র শালাতো আরিফ, ফাইজলামি করলে তার সাথে করব”
“গাঁজা খাইচছ ব্যাটা?এমন খেলান খেলাইয়াম না, হালার পুত হালা”
খেলান খেলানোর মানে আমি জানি। ইন্ডিয়ান বাংলা সিনেমায় দেখেছি, খেলান খেলামু বলার পরমূহূর্তেই শুরু হয়ে যায় টিসুম টিসুম।
আমি বুদ্ধিমান লোক, কেও আমারে কেলানি খেতে দেখলে মান ইজ্জত আর থাকবো না। মোটর সাইকেল রেখেই দিলাম চোখ বন্ধ করে খিচ্চা দৌড়।
বাসায় এসে আবার ফোন দিলাম বলদডারে,”তেলের ট্যাঙ্কির ভিতরে সাপ গেল ক্যামনে?”
“কেন স্যার”
“পাম্পের গাঞ্জুট্টি বদমাইশটা তেলের ট্যাঙ্কি খুইল্যা ভিতরে তাকাইয়েই কয়, স্যার, আপনার তেলের ট্যাঙ্কিতে কি সুন্দর একটা সাপ।”
“স্যার!”
“কি হল, এমনভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
“ম্যাডাম, ম্যাডাম! স্যারের কি হইছে, দেখেন জ্বর আইছে মনে হয়, প্রলাপ বকতাছে! কিসের জানি সাপের কথা কইতাছে”
ভদ্রমহিলা হায় হায় করে এসে প্রলাপ বকতে লাগল, কি হয়ে গেল রে, সুস্থ মানুষটা মোটর সাইকেলে তেল ভরতে গেল, আর সাপের কামড় খাইয়া আসল, ওরা কি পাম্পে সাপ পালে? পাম্পের খালি পুরান ট্যাঙ্কিতে সাপে গিজ গিজ করে। “আরে বলদ তুই ম্যাডামরে ডাকলি কেন?”
“ম্যাডাম” ডাক দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে।
“কি হল”
“তেলের ট্যাঙ্কিতো ফুল, আমি নিজে ভরে দিছি, চৌদ্ধ লিটার, তেল ভরবে কোথায়?!”
“তোর মাথায়, বলদ, এ কথা আগে বললে তো আর আমার দুই কিমি মোটরসাইকেল ঠেলতে হয় না, যা গাড়ি পড়ে আছে পাম্পে, নিয়ে আয়।”
আজ ঈদ।
মোটর সাইকেলটা চালানোই হয় না, টুকটাক চালাই, সময়ই পাই না, দরকারও পড়ে না।
কিন্তু আজ চালাব, চালাবই, সবাই কেমন ঘুরছে, ভাব মারছে। সখটা আবার মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে।
বাইকটা বের করার মূহূর্তে আজ আবার প্রতিবেশী পাতলাটার সাথে দেখা, “আঙ্কেল কি এইবার চামড়ারর ব্যবসা ধরছেন?”
থাক আজকে ঈদের দিন, কিছু বললাম না। বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠতে পারলাম না, এক চাচা বলছে “এই সমির, চামড়া আর কাওরে দিস না, আমরার নিজেরার লোকঅই যহন আছে।”
আরেকটু এগিয়ে গরুটা কেমন দেখার চেষ্ঠা করতেই একজন বলছে, দেইক্কা লাভ নাই, বেছা অইয়া গেছে।”
“কি বেচা অইয়া গেছে”
“মানে? ফাইলামি করুইন? আফনি কি জোরে নিবাইনগা চামড়া? কইছিতো বেছা অইয়া গেছে”
“আমি চামড়া কিনি না, আমারে দেখে কি চামড়া ব্যবসায়ী মনে হয়?”
“হ, বুইজ্জি, কিনুইনা তে কতা বাড়াইন কেরে?” সাথের জন বলছে ” কিনতাল্ল না দেইক্কা সরম পায়া কয় চামড়া কিনে না।”
নাহ্, এভাবে ঘুড়লে বাঁকিটুকুও থাকব না। বড় রাস্তায় একটু স্পিডে চালাতে হবে আর চামড়ার কাছে যাওয়া যাবে না।
চলছি….
ময়মনসিংহ মেডিক্যালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় লোকের জটলা।
আরে লোকগুলো রাস্তার উপর দাড়িয়ে আমাকে ডাকছে কেন! গাড়ি লাইট জ্বালানো নাকি! না, লাইটতো ঠিকই আছে। তাহলে কি কিছু পড়ে গেল? না, কিছুতো নিয়ে বের হইনি! তাহলে কোন বিপদ হলো না তো!
থামতেই “ভাই, আমাদের পাঁচজনের চামড়া একসাথে রেখে দিয়েছি, রাস্তার পাশেই, আপনার কষ্ট করতে হবে না, নিয়ে যান ভাই, প্লিজ।”
“ভাই আমি হাসপাতালের কেউ না, আপনাদের চামড়া ঠিক করা, প্লাস্টিক সার্জারির ব্যাপার, হাসপাতালের কারও হেল্প নেন।”
“মজা লন কেরে? আপনি চামড়া কিনেন আপনার এইডার জন্য সময় আছে। কিন্তু আমডারতো আরও কাম আছে, গোস্তের কাম।”
“আরে কিসের চামড়া, কেন নিব?”
“খাসির”
“আরে ভাই, আমি ঘুরতে বের হইছি, চামড়া কিনি না।”
“ফাইজলামি করেন। সিন্ডিকেট করেন। মাইনষের মাইরত খাইছুইন না, যেইদিন মাইনষে চাফায়চুফায় মারব, হেইদিন বুজবাইন।”
“আরে ভাই, কি বলছেন, এইসব? আমি চামড়ার কারবার করি না।”
“হালার পুত, অহন যুদু কইতাম গুরুর চামড়া, তে ত কামুড় দেয়া ধরতে! খাসির চামড়া ফুসা না, না?” আরেকজন, “বিশ টেহা হইরা চামড়া নিবে তাও ভাব ধরছ?” আরেকজন, “কুত্তার বাচ্চারা সিন্ডিকেট কইরালছে। অহন হেরাইত সব”
“আরে ভাই আমার নিজের চামড়াইতো বিশ টাকায় বিক্রি করছি, আমি ব্যাপারি না”
“তর চামড়া আমরা তুইল্লেয়া কুত্তারে খাওয়াইয়াম, বিশ টেহাও দাম নাই তর চামড়ার,…. পুত”
আমি জ্ঞানী লোক, ভাব বুইজ্জেলছি।
দে চোখ বন্ধ করে খিচ্চা দৌড়….
“এ…. পুত, গাড়ি লইয়া যা, আইজ্জয়া ঈদের দিন…..
“ভাই চামড়াডা লইয়া যান”
“ঠেহা শেষ”
“ভাই চামড়াডা নেন”
“ঠেহা শেষ ভাই”
“ভাই চামড়াডা কিনবেন না?
“ঠেহা শেষ”
“কি … লডা লইয়া ব্যবসায় নামছেন? আচ্ছা, ঠেহা পরে দিয়েন”
“ভাই আমার বাড়ি অনেক দূর”
“ভাই সমস্যা নাই, কোনদিন এইদিকে আইলে ঠেহা দেয়া যাইয়েন, আর না আইলে দাবি নাই, এই কাসেম চামড়াডা ভাল করে বাইন্ধা দে তো মোটরসাইকেলে!”
আবদুর রব খোকন
সহকারী অধ্যাপক
সরকারী আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ।