সুলতান আফজাল আইয়ূবী
সৈয়দ মুজতবা আলীর সাথে প্রথম পরিচিত হই ৭ম শ্রেনীর বাংলা বইয়ে ওয়াতানাম নামক দেশপ্রেমের এক অনন্য গল্পের মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যে রম্যলেখক হিসেবে পাকাপোক্ত স্থান আছে তার দখলে। তিনি নিজের লেখায় নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। নিজের সম্পর্কে কোথাও কিছু বলতেন না। এমনকি হয়তো বলতে পছন্দও করতেন না। তিনি সত্যপীর, রায়পিথোরা, ওমর খৈয়াম, টেকচাঁদ, প্রিয়দর্শী ইত্যাদি ছদ্মনামে আনন্দবাজার, বসুমতী , সত্যযুগ, শনিবারের চিঠি, দেশ, প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখতেন। তার সম্পর্কে ভিতরের বাইরের নানা প্রসঙ্গ- অপ্রসঙ্গ ও তার সাথে কাটানো সময়ের নানা স্মৃতিকথা তুলে নিয়ে এসেছেন গোলাম মুস্তাকীম তার “সৈয়দ মুজতবা আলী : প্রসঙ্গ,অপসঙ্গ” বইয়ে। গোলাম মুস্তাকীম ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ১৯৭৪ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এ মহান ব্যক্তি সৈয়দ মুজতবা আলীর সহচার্যে ছিলেন। গোলাম মোস্তাকীম তুলে ধরেছেন মুজতবা আলীর শৈশব থেকে শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নকালের সময়ে নানা গল্প! উঠে আসছে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রথম বই ‘দেশে-বিদেশে’ প্রকাশের পিছনে কিছু অপ্রকাশের কথা। অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত কালজয়ী মানুষদের কিছু গল্প জানা যাবে বইটিতে। মুজতবা আলীর সাথে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি তুলে ধরছেন ভিতরের বাইরের ও তৎকালীন সমাজ ও পরিবেশের বাস্তবচিত্র। যাকে এক কথায় আমরা বলতে পারি শিষ্যের কলমে উঠে এসেছে গুরুর ব্যক্তিগত জীবন। এ রম্য সাহিত্যিকের বই পড়লে পাঠক যেমন অসম্ভব ভালোলাগার মোহে মোহিত হয়। ঠিক মুজতবা আলীর বাস্তব কিছু গল্প এই বই থেকে পড়লে পাঠক অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। পাঠক জানবেন ভিতরের মুজতবা আলীকে। ১৬০ পৃষ্টার এ বইটি পড়লে প্রতিটি পৃষ্টায় খোঁজে পাবেন নানা স্বাদ ও অন্যরকম মুগ্ধতা। বইটির শেষে মুজতবা আলীর বংশপরিচয়, ঘটনাপঞ্জি, ও নির্ঘন্ট বইটিতে বৈচিত্রতা এনেছে। বইটির পাতায় পাতায় থাকা মুগ্ধকর নানা ঘটনা – অঘটনার কিছু অংশবিশেষ তুলে ধরা হল।
১. বইটির প্রথমেই জানা যাবে গোলাম মুস্তাকীম যখন প্রথম মুজতবার আলীর কাছে যান। তখন আলী সাহেব তাকে অপমান করে বাড়ী থেকে বের করে দেন। কিন্তু লেখক হাল ছাড়ার পাত্র নয়। তিনি নানা ভাবে ক্রমশ আলীর সাথে পরিচিত হলেন,মুজতবা আলীর ভিতরে প্রবেশ করলেন। যার ফলশ্রুতিতে লিখিত হল “সৈয়দ মুজতবা আলী : প্রসঙ্গ, অপ্রসঙ্গ”।
২.বিদ্যাসাগর এবং মাইকেল নিয়ে আর একদিন কথা উঠলো। তিনি বললেন, একবার এক লোক এসে বিদ্যাসাগরকে বললে, আপনি যে মাইকেলকে টাকা ধার দেন সেই টাকা দিয়ে সে কি করে জানেন? বিদ্যাসাগর অম্লানবদনে বললেন, সে ঐ টাকা দিয়ে মদ খায়। লোকটি বলল, আপনি মদ্যপান বিরোধী হয়ে জেনেশুনে মাইকেলকে মদ খাওয়ার জন্য টাকা দেন? এ কেমন ধারা কথা হল? উত্তরে বিদ্যাসাগর বললেন, টাকা না পেলে মাইকেল আজেবাজে মদ খেয়ে অকালে মারা যাবে। ‘তাহলে আমাদের টাকা দিন মদ খাওয়ার জন্য। হেসে বিদ্যাসাগর বললেন, হ্যাঁ তুমি আর একখানা মেঘনাদবধ কাব্য লিখে নিয়ে আসো, তোমাকেও আমি মদ খাওয়ার জন্য টাকা দিবো।
৩. তখন আমি দিল্লী। ছোট ছেলে কবীরের জন্মহলে স্ত্রীর কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেলাম যে আমার ছেলে হয়েছে। নাম রাখতে হবে। কি জ্বালাতন। আমিও কম যাই না।খবর দিলাম ছেলের নাম রাখো ভজুরাম।কলকতায় বিস্তর নেপালী দারোয়ানের নাম ভজুরাম। কাজেই ঐ নামটা পাঠিয়ে কৌশলে বউকে জানিয়ে দিলাম যে ভবিষ্যতে আমার ছেলে মেয়ের নাম রাখার জন্য আমাকে যেন অকারণে বিরক্ত না করা হয়।
৪.ফেরিওয়ালাদের সম্পর্কে তার পোচুর কৌতুহুল ছিল। বলতেন যে লোক আমাকে কলকাতায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরিওয়ালার ডাক বুঝিয়ে দিতে পারবে তাকে আমি একশত টাকা দিব। আমি ভাবলাম ফেরিওয়ালার ডাক বুঝে কি হবে? তিনি বললেন “তোমার চারপাশে যা ঘটছে সে সম্পর্কে তোমাকে সদা জাগ্রত থাকতে হবে। তা না হলে কিছুই শিকতে পারবে না। তোমার বইয়ের বিদ্যার সঙ্গে তোমার বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলাতে পারলেই তুমি কোন কিছু করতে পারো, লিখতে পারো। অন্যথায় নয়।”
৫.রবি ঠাকুরের বড় মেয় মাধুরীলতার বাসায় প্রায় প্রতি দুপুরে কবি পালকিতে করে অসুস্থ মেয়েকে দেখতে যেতেন। মেয়েকে শুনানোর জন্য গল্প -কবিতা লিখে নিয়ে যেতেন। বাপ মেয়ে দুজনেই সাহিত্যচর্চা করতেন। একদিন বাড়ীর কাছে যেতেই শুনলেন কান্নার রোল।খোঁজ নিয়ে জানলেন মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। রবি ঠাটকুর বেহারাদের বললেন ‘পালকি ঘুরাও’ মৃত মেয়েকে না দেখেই তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে চলে আসলেন।
৬.রবি ঠাকুর যে জীবনে কি দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন তা সাধারণ লোক কল্পনাও করতে পারবে না। সবারই ধারণা রবি ঠাকুর জমিদারের পুত্র ছিলেন।তাঁর কোন অভাব ছিল না।কিন্তু অনেকেই জানেন না রবি ঠাকুর শেষ জীবনে তাঁর হাত ঘড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
৭.পাঞ্জাবীরা নিজেদের খাটি মুসলমান বলে দাবী করে। কিন্তু আমার জানামতে ওদের মত অসভ্য ও বর্বর জাত দুনিয়ার তে দুটি নেই।অদের মধ্যে যত লম্পট, মদ্যপ আর হোমোসেক্সুয়াল আছে দুনিয়ার আর কোন জাতে আছে কিনা সন্দেহ। সত্যি কথা বলতে কি, সত্যিকার অর্থে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যেই আমি ধর্মভীরু,খোদাভীরু মুসলমান দেখেছি। জানো ত দুনিয়ার সব বড় বড় পোর্টে দুনিয়ার নামকরা প্রস্টিটিউশন আছে। আমি যখন ইউরোপ গিয়েছি,তখন পূর্ব বাংলার কোন খালাসীঃ সিলেট,চিটাগাং নোয়াখালীর কোন খালাসীকে আমি প্রস্টিটিউশনে যেতে দেখিনি।
৮. টলস্টয়ের যে কোন উপন্যাস ই তোমাকে কমপক্ষে তিনবার পড়তে হবে।
৯. হিটলারের একটা মজার কথা আছে।তিনি বলতেন, ১০০ টা বই পড়ে নব্বইটা ভুলে যাওয়ার চেয়ে ১০ টা বই পড়ে ৯টা মনে রাখা অনেক ভালো।
১০. আরবী ভাষাভাষী দেশে বিশেষ করে মিশরে এক বন্ধু সম্ভব হলে আর এক বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করে। কারণ তাদের বিশ্বাস বন্ধু হয়ে সেতো তার বন্ধুকে আজেবাজে মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারে না ।
১১.যদি কোনদিন সাহিত্য চর্চা করতে চাও তাহলে দুটো বই খুব ভাল করে পড়বেঃ আরব্যপোন্যাস ও জাতক।জাতকের মত ভাল বই খুব কম আছে।বাংলায় সাহিত্য চর্চা করতে চাইলে তোমাকে জাতক অবশ্যই পড়তে হবে।
১২. যদি লেখক হতে চাও তবে তোমার পাঁচটা জিনিষ থাকতে হবে।
a.Wide Travelling
b.Depth of Travelling
c.Characterisation
d.Sens of Lyricism
e.Imagination
১২. আমাদের রসুলের (দঃ) কাছে এক কবি আসতেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি।
কিন্তু তিনি নবীজীর কাছে আসলেই নবীজী তাকে খুব খাতির করে বসাতেন। অন্যান্য সাহাবীরা বেশ অবাক হয়ে যেতো। সেই কবি চলে যাওয়ার পর সাহাবীরা হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করতেন, হে নবী, আপনি ঐ বিধর্মীকে এত সম্মান করেন কেন? সেতো আপনার ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করে নি। নবীজী উত্তরে বলতেন, ঐ কবি আল্লায় বিশ্বাস না করলেও আল্লাহ ওকে ঠিকই ভালবাসেন। কারণ আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কেউ কবি হতে পারে না।
সব মিলিয়ে এক বসাতেই পড়ার মত একটা বই। গোলাম মুস্তাকীম তুলে এনেছেন মুজতবা আলীর ভিতর বাহির। লুকিয়ে থাকা মুজতবা আলীকে পরিচিত করেছেন মুজতবা পাঠকমহলে। গোলাম মুস্তাকীমের ‘সৈয়দ মুজতবা আলী :প্রসঙ্গ, অপ্রসঙ্গ ‘ একটি স্বার্থক গ্রন্থ।
বই: সৈয়দ মুজতবা আলী : প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ
লেখক: গোলাম মুস্তাকীম
প্রকাশক : স্টুডেন্ট ওয়েজ
প্রথম প্রকাশ :শ্রাবণ ১৪০২
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
মূল্য : ১২০
উৎসর্গ : জান্নতবাসিনী মা