সুলতান আফজাল আইয়ূবী
গত ০৮ ডিসেম্বর -২২ সালে আমার প্রোগ্রাম ছিল টাঙ্গাইলে সদর ঈদগাহ ঐতিহ্যবাহী কেডি ঈদগাহ মাঠে। প্রোগ্রামটি ছিল পরিচিত এক বন্ধুর মাদ্রাসায়, সেই সুবাদে সেখানেই রাত্রীযাপন করি। রাত্রে গুগল ম্যাপে দেখতে পেলাম মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র ৬ কি:মি: দুরে। এমন সুবর্ণ সুযোগ মিস করাটা ঠিক হবেনা ভেবে ভোরে ফজরের সালাতের পর সফরসঙ্গী নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বন্ধুবর জামান রুদ্রকে নিয়ে রওয়ানা দেই মাভাপ্রবির উদ্দ্যেশ্যে। টাঙ্গাইল নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে ৬০ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে আমরা পৌঁছালাম রাজনীতির নীতি-নৈতিকতার বাতিঘর, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রাণ পুরুষ মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর স্মৃতি বিজরিত সন্তোষে।
টাঙ্গাইলের সন্তোষে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর বাড়ি। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। মূল ফটক থেকে আরেকটু ভেতরে যেতেই একজন গার্ড আমাদেরকে থামিয়ে দিলেন, বললেন রিক্সা রেখে হেটে যেতে।
পথিমধ্যে চোখে পড়লো ‘কাগমারী স্মৃতিস্তম্ভ’ মাওলানার ভাসানীর অবিস্মরণীয় কীর্তি এবং উপ-মহাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে ১৯৫৭ সালের ‘কাগমারী সম্মেলন’। ১৯৫৭ সালের ৬, ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মওলানা ভাসানী ৫৪টি তোরণের মধ্য দিয়ে ‘ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন’ উদ্বোধন করেন। এ সম্মেলনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন জাতীয় নেতৃবর্গ উপস্থিত হয়েছিলেন।ঐতিহাসিক কাগমারী মাঠেই ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর ডাকে বিশাল ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশ হয়েছিল। পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ববাংলার মানুষের উপর জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদে মূলত কৃষক সমাবেশ হলেও সারাদেশের শ্রমিক-ছাত্র-জনতা এই কাগমারী সম্মেলনে সমবেত হয়েছিল। এই সমাবেশ থেকেই মাওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে ‘আসসালামুআলাইকুম’ বলে প্রয়োজনে প্রত্যাখ্যানের কথা বলেছিলেন। ঐতিহাসিক এই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে রুদ্র আর আমি ছবি তুললাম, আর স্মৃতিস্পটে ভাসছিলো কি দাপটে মাওলানা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়াজ কন্ঠে চেতনার হুংকার দিয়েছিলেন!!!!
১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
আমরা কাগমারী থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই মাওলানা ভাসানীর মাকবারায়। কাছাকাছি গিয়ে ভেতরে ভাসানীর বাড়ি ও সমাধিস্থল। কবরকে বরং গতানুগতিক মাজার বলাই সঙ্গত। যে ভাসানী পুরোনো ইস্রিহীন পাঞ্জাবী আর তালের আঁশের টুপি পড়ে কাঁপাতেন সৈরাচারীর মসনদ। যে ভাসানী সম্পর্কে আহমদ ছফা এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মাওলানা ভাসানী ছিলেন হাড়ে, মাংসে, অস্থিমজ্জায় কৃষক সম্প্রদায়ের নেতা। স্বভাবে, আচরণে, জীবনযাপন পদ্ধতিতে তিনি নিজেও ছিলেন মহান কৃষক। তাঁর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৃষকসমাজ। যখনই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তিনি মনে করেছেন, এই দলটির সঙ্গে কাজ করলে কৃষকসমাজের দাবিদাওয়া এগিয়ে নিতে পারবেন। পরক্ষণে যখনই তাঁর মনে হয়েছে, এই দলটি কৃষকসমাজের স্বার্থবিরোধী, কায়েমি স্বার্থের তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে। তখনই দল ছাড়তে তাঁর একমুহূর্ত সময়ও ব্যয় হয়নি।’ সেই বিপ্লবীর সব চেতনা ধুলিসাৎ করে কিছু ভক্তরা তাঁর কবরকে আজ মাজার বলেন। অবশ্য মাজার হলে সব দিক দিয়েই সবার্থবাজ গোষ্ঠীর জন্য আশার আলোর প্রজ্বলন।
বিশাল উঁচু ছাদ এবং বিস্তৃত জায়গা নিয়ে সমাধিস্থল। লালসালুর মধ্যে নকশাঁর কাজ করা কাপড়ে আচ্ছাদন রয়েছে দুটি কবরে। পাশাপাশি দুটি কবর এখানে। একটি মাওলানা ভাসানীর অপরটি তাঁর স্ত্রী আলেমা ভাসানীর। কবরের পাশে একটি কুঁড়েঘর। মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দল ন্যাপের নির্বাচনী প্রতীক কুঁড়েঘর। আমরা কুঁড়েঘরের ভেতরে ঢুকে দেখতে পাই ভাসানীর ব্যবহৃত কাঠের মিটসেফ এবং চেয়ার রাখা আছে। যেই চেয়ারের ক্ষমতা আকাশচুম্বী। আমি হাত দিয়ে স্পর্শে করলাম মাওলানা ভাসানীর ব্যাবহৃত চেয়ার।আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠলো!! বন্ধুবর রুদ্র দেখছিলো আমার পাগলামী। অবশ্য সে আমার এসব আবেগের জায়গা সম্পর্কে পূর্বেই জ্ঞাত ছিল।
সমাধিস্থলের তত্ত্বাবধায়ক বা খাদেম আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখান এবং হুজুর সম্পর্কে নানাকিছু বর্ণনা করেন। কবরের বামপাশে একটি কক্ষ সংরক্ষিত আছে। এখানে মাওলানা ধ্যানে বসতেন বলে জানালেন খাদেম সাহেব। আসলে মাওলানা এই কক্ষটিকে ব্যক্তিগত অধ্যয়ন এবং প্রার্থনার জন্য ব্যবহার করতেন। খাদেম জানান প্রতি বছর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে এখানে ‘ওরস’ হয়।
খাদেম সাহেব হুজুরের অলৌকিক শক্তি সম্পর্কে আমাদেরকে অনেক কিছুই কি বলছিলো! কিন্তু আমার চোখে ভাসানীর মূল আলৌকিক কারামত হলো ভাসানীর বিপ্লবী চেতনা। ভাসানীর সমাধিস্থলের বাইরে পৃথক দুটি সমাধিতে শায়িত রয়েছেন তাঁরই দুই ছেলে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা। সব কিছুই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরেই। আমরা মূল সমাধিস্থলের বাইরে এসে দরজার পাশে দেয়ালে টাঙ্গানো ব্যানারে দেখতে পাই মাওলানা ভাসানী ৪টি মারিফতি ধারার শেষ প্রতিনিধি। খাদেমও ব্যাখ্যা করে বললেন মাওলানা চারটি ধারার অনুসারী ছিলেন। তাঁর মূল পীরসাহেব ভারতের। ভবনের বাইরের দেয়ালে আরো কয়েকটি ব্যানারে মাওলানা ভাসানীর জীবনপঞ্জী টাঙ্গানো আছে। এখানে ভাসানীর কিছু রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের কথা আছে। আছে তাঁর সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসের কথাও। যদিও মাওলানা ভাসানীর এই সমাজতন্ত্র ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ বলা যায়। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর পীর পরিচয়টাই এখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে। অথচ মাওলানা ছিলেন এই উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব! আসলে তাঁর মূল পরিচয়ই রাজনৈতিক পরিচয়।
রাজনৈতিক এ মাওলানার আরেকটা পরিচয়, পাকিস্তান আমলে এক মসজিদের প্রাঙ্গনে একবার তাঁর বক্তৃতা দেয়ার কথা।বহুদূর থেকে মানুষ এসেছে জননেতা ভাসানীর কথা শুনতে। চারদিক লোকে লোকারণ্য। এমনসময় পাকিস্তানী সেনারা ঘিরে ফেলল মসজিদ। পুলিশ এসে মাওলানা সাহেবকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ! শেখ মুজিব ছিলেন তার পাশে ! তিনি সহ আরো যারা ছিলেন , তারা চিতকার করে উঠলেন যে,”মানিনা ১৪৪ ধারা ,আমি বক্তৃতা করবো “। “মাওলানা সাহেব দারিয়ে বললেন ,”১৪৪ ধারা জারি হয়েছে , আমাদের সভা করতে দেয়া হবে না । আমি বক্তৃতা করতে চাইনা ,তবে আসুন আপনারা মোনাজাত করুন,আল্লাহুম্মা আমিন।মাওলানা সাহেব মোনাজাত শুরু করলেন।মাইক্রোফোন সামনেই আছে । আধা ঘন্টা পর্যন্ত চিৎকার করে মোনাজাত করলেন,কিছুই বাকি রাখলেন না,যা বলার সবই বলে ফেললেন !পুলিশ অফিসার , সেপাইরাও হাত তুলে মোনাজাত করতে লাগলো ! আধা ঘন্টা পুরো বক্তৃতা করে মাওলানা সাহেব সভা শেষ করলেন।পুলিশ ও মুসলীম লীগ ওয়ালারা বেয়াকুফ হয়ে গেল ! এই ছিলেন মাওলানা!!!!
সন্তোষে নতুন কেউ এলে, যিনি মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন এবং সংগ্রাম সম্পর্কে পূর্বে অবগত না হন, তিনি নিশ্চিতরূপে ভাসানীকে ‘কামেল পীর’ ভেবে ইচ্ছে পূরণের তবারক খেয়ে কিছু একটা মানত করে প্রশান্ত চিত্তে ঘরে ফিরবেন! খাদেম সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা হুজুরের আধ্যাত্মিক কেরামতির পরিচয় তো পেলাম কিন্তু তিনি যে রাজনৈতিকভাবে অসাধারণ ‘কেরামতি’ জানতেন তার নিদর্শন কোথায়? বললেন পাশেই জাদুঘর আছে।
মওলানা ভাসানীই উপমহাদেশের একমাত্র রাজনীতিক যিনি ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয় করেছিলেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। তিনি ধর্মের বিপ্লবী আদর্শকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছিলেন সাফল্যের সাথে। তিনি একই সাথে ছিলেন ধর্মবেত্তা ও বিপ্লবী রাজনীতিক। তিনি ধার্মিক ছিলেন সাম্প্রদায়িক না হয়ে আবার বিপ্লবী ছিলেন ধর্মকে বিসর্জন না দিয়ে। পীর হয়েও তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পছন্দ করতেন না কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধকে রাজনীতিতে প্রয়োগের পক্ষপাতি ছিলেন। এটিই ছিল তাঁর রাজনীতির মূলতত্ত্ব যাকে বিপ্লবী ধর্মতত্ত্ব (Revolutionary Theology) বলা যায়।
[মওলানা ভাসানীঃ রাজনীতি, দর্শন ও ধর্ম; ড. মোঃ ফোরকান মিয়া]
জাদুঘরের বাইরে সংরক্ষিত চীন বিপ্লবের মহান নেতা মাও সে তুং কর্তৃক উপহার দেয়া একটি ট্রাক্টর দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। এই ট্রাক্টর দিয়ে ধানচাষ হয়েছিল কিনা জানি না। আসলে ছোট্ট এই জাদুঘরে তেমন কিছুই নেই। কিন্তু আক্ষেপ আমাদের জাদুঘর দেখা না-দেখা নিয়েও নয়। আক্ষেপ হচ্ছে মাওলানা ভাসানীর মতো নেতা যখন স্রেফ একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পীরে পরিণত হন সেটা নিয়ে।
আরেকটি কারণে আক্ষেপ হয়, আসলে ‘লাল মাওলানা’ যেনো কারোরই হতে পারেননি। তিনি ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে একজন নিঃসঙ্গ পরিব্রাজক। জন্মস্থান সিরাজগঞ্জ। এরপর আসাম, পশ্চিম বাংলা, পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের সর্বত্র যেখানেই রাষ্ট্রীয় বা আঞ্চলিকভাবে কোনো নিপীড়ন-নির্যাতন, অত্যাচার-জুলুম সংঘটিত হয়েছে সেখানেই মাওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করেছেন। মানুষকে সংগঠিত করেছেন। সর্বশেষ বয়োবৃদ্ধকালেও ১৯৭৬ সালে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহ দিক তুলে ধরে তাঁর নেতৃত্বেই ভারত অভিমুখে একটি লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মাওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করেছে অনেকে কিন্তু তিনি কাউকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেননি। তাই মুসলিম লীগের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী-মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং সর্বশেষ ন্যাপের মতো বিশাল সংগঠনের মাধ্যমে প্রায় সকল বামপন্থীদের সংগঠিত করেও শেষ পর্যন্ত সব যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল। খন্ডবিখন্ড হয়ে যাওয়াই যেনো ঐতিহাসিক নিয়তি ছিল মাওলানা ভাসানীর ন্যাপের এবং এই দেশের মানুষের স্বপ্নেরও। আজও অনেকে ভাসানীর জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করছেন নানাভাবে। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, মাওলানা তুমি কার? এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, নেতা যতোই বড় বা জনপ্রিয় হোন না কেন যথার্থ গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠন গড়তে না পারলে মৃত্যুর পর তাঁর নাম থাকবে কিন্তু সংগঠন থাকবে না।
ভাসানীর মাকবারা জিয়ারত করলাম, দোআ করলাম, ভাসানীর চেতনায় বাঙ্গালি জাগ্রত হোক। খাদেম আমাদের কয়েক টুকরো বাতাসা দিলেন বললেন এগুলো সিন্নি! মাজারে এলে নাকি বরকত হিসেবে খেতে হয়!!!! স্বল্প সময়ের জিয়ারতের মধ্য দিয়ে আমরা ত্যাগ করলাম ভাসানীর স্মৃতি বিজরিত পূন্যভূমি থেকে!!!!!
ম্যানেজিং ইডিটর
পাকুন্দিয়া প্রতিদিন