হুমায়ুন কবির, সিনিয়র রিপোর্টারঃ সমাজসেবা অফিসে সেবা/ ভাতা নিতে কোন টাকা লাগে না, কথাটি প্রতিটি অফিসের সামনে ও বিভিন্ন ভাবে সমাজসেবা মন্ত্রণালয় প্রচার দিলেও কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের ভিতরের চিত্র একেবারেই ভিন্ন, টাকা ছাড়া কোন সেবা মিলে না। প্রতিবন্ধী বয়স্ক-বিধবা ভাতার কার্ড তৈরিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অফিসের কর্মচারীদের টাকা না দিলে ভাতার কার্ড মেলে না। সমাজসেবা অফিসের অনিয়মের বিরুদ্ধে একাধিক বার বিভিন্ন মিটিং এ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কয়েকজন অসাধু কর্মচারী অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে অনৈতিক পন্থায় ভাতার কার্ড তৈরি করে দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী না হয়েও টাকার বিনিময়ে সচ্ছল পরিবারের মাঝে এসব কার্ড বিতরণ করা হয়। ফলে এলাকার প্রকৃত হতদরিদ্র মানুষ প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরজমিনে দেখা যায়, সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি সহ কয়েক জন বিভিন্ন ব্যাক্তির ফাইল হাতে নিয়ে এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যোগাযোগ করছেন। যারা টাকা দিচ্ছে অফিসের লোকজন কে তাদের কাজ করে দিচ্ছেন। আর যারা হতদরিদ্র বয়স্ক, বিধবা, জন্ম প্রতিবন্ধী টাকা দিতে পারেনি তাদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা সমাজসেবা অফিস কিংবা জনপ্রতিনিধিদের কাছে দিনের পর দিন মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে। এতে করে যাতায়াত ভাড়া সময় নষ্ট করে কোন কাজ হচ্ছে না। তাই অনেক প্রতিবন্ধী, হতদরিদ্র বয়স্ক বিধবারা বই করতে আগ্রহ হারিয়ে নিরুপায় হয়ে ভাতা বইয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
উপজেলার জাঙ্গালিয়ার জুয়েনা খাতুন বলেন, আমি জন্ম প্রতিবন্ধী, ২০১৬ সালের জুন মাস থেকে “সুবর্ণ নাগরিক ” পরিচয়পত্র পেয়েছি, ২০২২ সালের ১৬ ই আগষ্ট অনলাইনে ভাতার কার্ডের জন্য আবেদন করি।তারপর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা সমাজ সেবা অফিসে অনেক বার গিয়েছি ভাতার বইয়ের আশায় কিন্তু বই পাইনি। ব্যাংক এশিয়া গিয়ে একাউন্ট খুলেছি কিন্তু অফিস থেকে ভাতার বই না পাওয়ায় টাকা তুলতে পারিনি। অফিসে গেলে বলেন মেম্বারের কাছে যান আর মেম্বার বলে বই অফিসে। সর্বশেষ এ বছরের মে মাসে সমাজসেবা অফিসে আসার জন্য লিখে দিয়েছিলেন, তারপর মে মাসে কয়েক বার অফিসে যোগাযোগ করে বই পাইনি, অনেকদিন এভাবে দৌড়ে আমি ক্লান্ত তাই ভাতার কার্ড করতে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন ইউনিয়নের একাধিক ভাতাভোগীরা জানান, অফিসের দ্বীন ইসলাম কে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে ভাতার কার্ড করে নিয়েছেন। টাকা না দিলে বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করেন।
চন্ডিপাশা ইউনিয়নের রহিমা বেগম ( ছদ্মনাম) জানান, আমি ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করি, সরকারের ঘোষণার পরে অনলাইনে আবেদন করি প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য, দীর্ঘদিন ভাতার বই না পেয়ে সুদে তিন হাজার টাকা নিয়ে দ্বীন ইসলাম কে দেওয়ার কয়েক মাস পরে বই করে দেয়।
তবে টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘আমি এখন জেলা অফিসে আছি, ভাতার বইয়ের কাজ আমার ছিলোনা, অফিসে এই কাজে মাঝে মধ্যে মানুষ কে সহযোগিতা করেছি, কারও কাছ থেকে টাকা নেইনি।
এ বিষয়ে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ বলেন, এ-ই অফিস নিয়ে আমি এমন একটা সমস্যার মধ্যে আছি যা বলার মতো নয়, এখানে যে অব্যবস্থাপনা কতটি বই নিয়ে গেছে তা বলা কঠিন। এ উপজেলায় বয়স্ক ভাতাধারী ১৫৩২৩ জন, প্রতিবন্ধী ভাতাধারী ৪২৬০ জন, বিধবা ভাতাধারীর সংখ্যা ৬২৯৬ জন। আর জুয়েনা খাতুনের আবেদন অনলাইনে নেই বলে জানান তিনি কিন্তু অনলাইনে চেক দিলে আবেদন ও ব্যাংক এশিয়ার এই ৪২৪০৩৯ অ্যাকাউন্ট নাম্বার টি ঠিক আছে দেখা যায়। শুধু ফিঙ্গার প্রিন্টের বাকি আছে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের উপ পরিচালক কামরুজ্জামান খান বলেন, খুব শীগ্রই প্রতিটি ইউনিয়ন ভিত্তিক লাইফ ভেরিফিকেশন হবে, যারা প্রকৃত প্রতিবন্ধী বা বিধবা না তাদের বই বাতিল করা হবে। যারা প্রকৃত ভাতা পাওয়ার যোগ্য তারা যদি ভাতা না পেয়ে থাকেন তাহলে আগামী আগষ্টের ১ তারিখ থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হবে আর যাদের অনলাইনে আবেদন করা আছে তাদের নতুন করে আবেদন করার প্রয়োজন নেই। ভাতার কতগুলি বই বিতরণ হয়েছে বা অবশিষ্ট বই অফিসে আছে তার হিসাব অফিসে নেই ধরনের বক্তব্য অফিস প্রধানের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। খুজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।