আমিন সাদিক
বারটি চান্দ্র মাসের নবম মাস রমজান। ‘রমজান’ শব্দটি আরবি ‘রামাদ’ থেকে এসেছে যার আভিধানিক অর্থ জ্বালানোবা পুড়িয়ে ভস্ম করা। রোজা মানুষের অহংকার,কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এর নাম ‘রমজান’।রমজানের দহনে রোজাদার গুনাহ মুক্ত হয়ে জান্নাতি মানুষে পরিণত হয়।
রোজা শব্দটি ফার্সি; যা আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। এর আরবি প্রতিশব্দ সিয়াম যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের পরিভাষায় মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহারও যৌনাচার থেকে বিরত থাকাকে সাওমবা রোজা বলে। কাম,ক্রোধ, মোহ,রিপু দমন,আত্মশুদ্ধি,ধৈর্য্যও আল্লাহভীতি অর্জনে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। রোজা ইসলামের পাঁচ ভীতের অন্যতম একটি এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিও সান্নিধ্য লাভের বিশেষ মাধ্যম।
“হে ঈমানদাারগণ!তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর,যেনো তোমরা আল্লাহতে সমর্পিত হতে পারো।”
সুরা বাকারা আয়াত ১৮৩।
এ আয়াত থেকে জানা যায় যে,আগে সব শরীয়তেই রোজা ফরজ ছিলো। একটি হাদিসেও একথাটি বর্ণিত হয়েছে। আগের শরীয়তসমূহে রোজা কোন ধরনেরবা কতোদিনের ছিলো, কোন মাস অথবা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত ছিলো কিনা এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অসম্ভব। হযরত আলুসির মতে হজরত আদম(আঃ) এর প্রতিও রোজার হুকুম ছিলো, কিন্তু সে রোজার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের জানা নেই। অন্য তাফসির বিশারদগণও এধরণের মত পোষণ করেছেন।এ সম্পর্কে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা আরিফ বিল্লাহ শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান (রহঃ)উপর্যুক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘রোজার হুকুম হজরত আদম( আাঃ) এর সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বিদ্যমান রয়েছে।’ হজরত নূহ( আাঃ) এর সময়ে বিস্তৃত শরীয়ত অবতীর্ণ হয়।তাঁর আগেও শরীয়ত ছিলো। কিন্তু পৃথিবীর তখন প্রারম্ভিক যুগ,তাই সে যুগে শরীয়তের বিষয়সমূহের ওহী ছিলো অত্যন্ত সীমিত। সে যুগে বেশির ভাগই ছিলো পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলী সংক্রান্ত ওহী।আর এ প্রশ্নে হজরত নূহ( আাঃ) এর যুগ ছিলো একেবারেই আলাদা। এ যুগ থেকেই শুরু হয় খোদাদ্রোহিতাও ওহীর আদেশের অমান্যতা।হজরত নূহ(আাঃ) কে লক্ষ্য করেই আল্লাহ এরশাদ করেন,”যারা ঈমান এনেছে তারা ছাড়া আর কেউ ঈমান আনবেনা।”তখন নূহ(আঃ) অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন,’ হে আমার রব!পৃথিবীর বুকে কোনো কাফিরের ঘর যেনো অবশিষ্ট না থাকে।’ হাশরের ময়দানে শাফায়াতের জন্য উম্মতরা সর্বপ্রথম হজরত নূহ( আাঃ)এর কাছে গমন করবে। হজরত নূহ( আাঃ)কে পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম রসুল হিসেবে ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘ আপনি বিশ্ববাসীর মাঝে শরীয়ত বর্ণনাকারী প্রথম রসুল।’ আল্লামা ইবনে কাসির স্বীয় প্রসিদ্ধ তাফসিরে লিখেছেন,হজরত জেহাক বলেছেন হযরত নূহের যুগ থেকে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালন করার হুকুম ছিলো এবং এ হুকুম বিশ্বনবী(সাঃ)এর যুগ পর্যন্ত বহাল ছিলো। এরপর যখন রমজানে রোজা পালনের হুকুম হলো তখন থেকে প্রতি মাসে তিনটি রোজা পালনের হুকুম রহিত হলো। এ বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় হজরত নুহ (আঃ)এর যুগে ও রোজার বিধান চালু ছিল। যখন আল্লাহ মুসা (আঃ) কে তুর পর্বতে ডেকে তাওরাত প্রধানের প্রতিশ্রুতি দিলেন তখন আল্লাহ হজরত মুসাকে সেখানে ৩০ রাত অবস্থানের নির্দেশ দিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, এবং স্মরণ করো ওই সময়কে যখন আমি মুসার জন্য ৩০ রাত নির্ধারণ করেছিলাম এবং আরো ১০ দ্বারা তা পূর্ণ করেছিলাম।এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত ৪০রাত পূর্ণ হয়।’ হজরত ইবনে আব্বাসের মতে হজরত মূসা (আঃ) জিলকদের ৩০ দিন ও জিলহজের প্রথম ১০দিন রোজা পালন করে আল্লাহর দরবারে হাজির হন এবং তাওরাত লাভ করেন।এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় হযরত মুসা (আঃ) এর যুগেও রোজার হুকুম ছিলো। হযরত ইবনে আমর কে রাসূল (সাঃ) রোজা পালনের আদেশ এভাবে করেছিলেন ‘আল্লাহর কাছে যে রোজা উত্তম সে রোজা রাখ। আর সে রোজা হলো যা দাউদ রেখেছেন। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আরেকদিন ইফতার করতেন।’এ হাদিস থেকে হযরত দাউদ (আঃ) এর যুগের রোজার সন্ধান পাওয়া যায়।বাইবেলে ‘দার’ বাদশাহের যুগে বাইতুল ইলের বাসিন্দা ও বনী ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার হুকুমের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এমনিভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সব শরীয়তেই রোজার সন্ধান পাওয়া যায়। বস্তুত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব জাতির মধ্যেই রোজা পালনের বিধান ছিল।বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) রজব মাস এলেই দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে রজবও শাবান মাসে বরকত দান করুন আর আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’
আত্মশুদ্ধির তাগিদে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ গোত্র ও ধর্মাবলম্বীর মধ্যে রোজার প্রথা প্রচলন ছিল। চীনারা একাধারে কয়েক সপ্তাহ রোজা রাখত। পারসিক হিন্দুদের মধ্যেও ছিল রোজার প্রচলন।
শুক্রবার দিন আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়। আর রোজার মাসে ইফতারের পূর্বে প্রতিদিনই দোয়া কবুল হয়।এই সময়টিতে রমজানের শেষ দশক অর্থাৎ নাজাত পর্বে মসজিদে ইতিকাফ কারী মুতাকিফ ব্যক্তি মসজিদে অবস্থান করেন।কুরআন নাযিলের রাত্রি লাইলাতুল কদর বা শবেকদর ও এই দশকের মধ্যেই রয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন ” রমজান হলো সে মাস,যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন,যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধান কারী।কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা রাখবে। ” (সুরা বাকারা আয়াত ১৮৫।)
আর কুরআন সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন,” নিশ্চয়ই একে(আল কুরআন) আমি এক মহিমান্বিত রজনীতে নাযিল(অবতীর্ণ) করেছি। তুমি কি জানো সেই মহিমান্বিত রজনী কি?মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম।এ রাতে রুহ ও ফেরেশতারা নেমে আসে প্রতিপালকের অপার অনুগ্রহ নিয়ে।ঊষালগ্ন পর্যন্ত বর্ষণ করে সমস্ত অকল্যাণ থেকে নিরাপত্তা ও শান্তি।” (সুরা ক্বদর আয়াত(১-৫)।)
এই রোজার মাসে পরম করুণাময়ের কাছে দোয়া করা হবে সিয়াম ও কিয়াম সাধনার ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে আমাদেরকেও তাঁর খাস রহমত,বরকত, মাগফেরাত ও ক্ষমা নসীব করে নাজাতপ্রাপ্তদের দলে শামিল করে নেওয়ার জন্য।
হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে,”রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেবো।” (বুখারী)
নামাজ, যাকাত,উষর,হজ্বের মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদত ও দান সাদকাসমূহ লোকদেখানো ও নাম কামাই করার জন্য কেউ করে থাকতে পারেন কিন্তু রোজা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কেননা,রোজাদার ব্যক্তি লোকচক্ষুর আড়ালেও পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকে।অন্য এক হাদিসে এসেছে,
“রোজা ঢাল স্বরূপ।”যুদ্ধক্ষেত্রে ঢাল যেমন যোদ্ধাকে শত্রুর অস্ত্রের আঘাত থেকে রক্ষা করে তেমনি রোজা মুমিনকে যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে রক্ষা করে। বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ বোখারি ও মুসলিমে উল্লেখ আছে হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত,রসুলল্লাহ(সঃ) ইরশাদ করেছেন,” যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমজানে রোজা রাখবে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” তিনি আরো বলেন, ‘জান্নাতের আটটি দরজা আছে তার একটির নাম রাইয়্যান।কিয়ামতের দিন এই দরজা দিয়ে শুধু রোজাদাররা প্রবেশ করবে।তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফলে রোজাদার ছাড়া অন্য কেউ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেনা।’
বুখারী,মুসলিম।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,’যে ব্যক্তি ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে তাকে জান্নাতের বিশেষ পানীয় পান করানো হবে,ফলে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবেনা।’
মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, নাসায়ি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর( রাঃ) থেকে বর্ণিত,রসুলল্লাহ(সঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘ তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয়না ( অর্থাৎ কবুল করা হয়)-১. ন্যায় পরায়ন শাসকের দোয়া ২.রোজাদারের ইফতারের সময়ের দোয়া ৩.মজলুমের দোয়া। তাদের দোয়া মেঘমালার উপর উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।তখন আল্লাহ তাআ’লা ঘোষণা করেন,আমার সম্মানের কসম! বিলম্বে হলেও অবশ্যই আমি তোমাকে সাহায্য করবো।’
মুসনাদে আহমাদ,তিরমিজি,ইবনে মাজাহ।
প্রিয় ভাইসব!রোজার পূর্ণ সওয়ার অর্জন এবং মহান প্রভুর সন্তুষ্টিও সান্নিধ্য পেতে হলে শুধু পানাহারও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকা যথেষ্ট নয় বরং মিথ্যা,প্রতারণা,সুদ,ঘোষ,ঝগড়া- বিবাদসহ যাবতীয় অশ্লীল কথাও কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং চোখ, কান,জিব,হাতপা সহ সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে গুণাহমুক্ত রাখতে হবে। সহীহ মুসলিমে আছে, ‘ তোমাদর মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখবে সে যেন অশ্লীল আচরণও ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকে।যদি কেউ তাকে গালি দেয়বা তার প্রতি মারমুখী হয় তবে সে যেনো বলে আমি রোজাদার।’প্রিয় নবী (সঃ) আরো বলেছেন,’যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা,অশ্লীল কর্মকাণ্ডও জাহেলি আচরণ পরিত্যাগ করতে পারেনা তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই। বুখারি।
রমজান মাস পাওয়ার পরে ও রোজাব্রত পালন ও রমজানের পবিত্রতা রক্ষার দ্বারা যে নিজেকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষা করলো না সে মহান আল্লাহর অভিসম্পাত ও গজবে নিপতিত। ( আল হাদিস) কাজেই রমজান মাসের ওয়াসীলায় আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে দিন। আমীন।
আমিন সাদিক
কবি, গবেষক ও সাবেক প্রভাষক,তাসলিমা মেমোরিয়াল কলেজ, কিশোরগঞ্জ।